ঢাকা, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

৭ আশ্বিন ১৪৩২, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

৫ ব্যাংকের জোরপূর্বক একীভূতকরণ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

আমানতকারীদের অর্থ কার্যত আটকে আছে

আনিসুল ইসলাম, ইউএনবি

প্রকাশ: ১৩:৩৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৩:৩৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

৫ ব্যাংকের জোরপূর্বক একীভূতকরণ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

ছবি: ইউএনবি।

বাংলাদেশে পাঁচটি শরিয়া-ভিত্তিক ব্যাংকের একীভূতকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপকে ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করার একটি সাহসী প্রচেষ্টা হিসেবে স্বাগত জানানো হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন যে, এই পদক্ষেপটি বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং এর ফল পেতে অনেক বছর সময় লাগতে পারে।

এই পাঁচটি ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকগুলো বর্তমানে সংকটে রয়েছে। তাদের খেলাপি ঋণের (NPLs) পরিমাণ ১ লক্ষ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৭৯ শতাংশ। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৮ শতাংশ, রিপোর্ট ইউএনবি’র। 

ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের অর্থ কার্যত আটকে আছে, এবং সেগুলো টিকে থাকার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশাল সহায়তার উপর নির্ভরশীল।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো চুরি হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যাতে এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা।"

তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, জাল নথি এবং বিদেশে সম্পদ পাচার পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তোলে।

এই ধরনের জোরপূর্বক একীভূতকরণ আন্তর্জাতিক নিয়মের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ব্যাখ্যা করেন, "বিশ্বজুড়ে দুর্বল ব্যাংকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষার পর শক্তিশালী ব্যাংকের কাছে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু একটি জোরপূর্বক একীভূতকরণ সংকটকে আরও খারাপ করতে পারে, যদিও এটি আমানতকারীদের অর্থ রক্ষা করতে পারে।"

একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটিও ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ ব্যাংক এর জন্য ৩৫,০০০ কোটি টাকা বাজেট করেছে, যার মধ্যে জাতীয় বাজেট থেকে ২৫,০০০ কোটি টাকা এবং ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০,০০০ কোটি টাকা আসবে। সরকারি তহবিল ব্যবহারের জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস সতর্ক করে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত সমস্যাগুলি ২০২৬ সাল পর্যন্ত চাপ সৃষ্টি করতে থাকবে। উচ্চ ঋণ ঝুঁকি, বিভক্ত কার্যক্রম, নির্বাহী ব্যর্থতা, এবং দুর্বল ঋণ দেওয়ার মানকে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিছু ব্যাংক, বিশেষ করে এক্সিম ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এই একীভূতকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দেখাচ্ছে। তাদের পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডাররা এই প্রক্রিয়া থেকে নিজেদেরকে বাদ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

এদিকে, সম্ভাব্য শাখা বন্ধ এবং চাকরি হারানোর উদ্বেগ রয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ অঞ্চলে নতুন শাখা খোলা এবং আমানত স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যাতে কর্মীদের ছাঁটাই কমানো যায়।

মূলধনের ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, এবং রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার কারণে এই একীভূতকরণের সফল পথটি বাধাগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, নতুন ব্যাংকটি স্থিতিশীল হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে, যা আমানতকারী, কর্মচারী এবং সমগ্র আর্থিক ব্যবস্থাকে এক অনিশ্চিত অপেক্ষার মধ্যে রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচটি ব্যাংকের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তাদের মোট আমানত এক বছরের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ৫৯ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে মে মাসে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এর বিপরীতে, তাদের মোট ঋণ ১ লক্ষ ৯৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকায় বেড়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো ঋণের ক্রমবর্ধমান খেলাপি অনুপাত। এই পাঁচটি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ (NPLs) বর্তমানে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮ শতাংশ।

এর অর্থ হলো, গ্রাহকদের জমা করা অর্থের একটি বড় অংশ এখন খেলাপি ঋণে আটকে আছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিশেষ সহায়তা নিতে হয়েছে। ব্যাংকগুলো ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকার বিশাল সঞ্চিতি ঘাটতিরও মুখোমুখি।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন