শহীদুল ইসলাম (মুকুল), হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক
প্রকাশ: ২১:১৮, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২১:১৮, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রতীকি ছবি। সংগৃহীত।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সকে অনেকে এখনো শুধু ডায়াবেটিসের আগাম সংকেত ভেবেই থেমে যান। কিন্তু সত্য হলো— এটি যেন এক অদৃশ্য ফাঁদ, যা শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ধীরে ধীরে জড়িয়ে ফেলে। আর তারই ফলাফল হিসাবে আসে ডায়াবেটিসের বাইরেও শত রোগের মিছিল!
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থেকে জন্ম নেওয়া রোগের তালিকা অনেক অনেক বড়। এখনও প্রতিনিয়ত গবেষণায় নুতন নুতন রোগের সন্ধান পাচ্ছেন গবেষকরা। নীচে কিছু প্রধান রোগের তালিকা তুলে ধরা হলো।
১️। টাইপ–২ ডায়াবেটিস
এটিই সবচেয়ে পরিচিত ফলাফল। ইনসুলিন কাজ না করায় গ্লুকোজ জমে যায় রক্তে। (আর আমরা ব্যস্ত থাকি শুধু রক্তের এই গ্লুকোজ কমানো নিয়ে। (এ যেনো টিকটিকি ছেড়ে দিয়ে তার খুলে দেওয়া লেজের পেছনে দৌড়ানো।)
২। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
দীর্ঘদিন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও উচ্চ রক্তশর্করার কারণে চোখের সূক্ষ্ম রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুরুতে ঝাপসা দেখা, আলো চারপাশে ছায়া বা ছোট কালো দাগ দেখা দেয়। চিকিৎসা না করলে এটি অন্ধত্ব পর্যন্ত গড়াতে পারে।
৩। স্থূলতা ও ফ্যাটি লিভার
অতিরিক্ত ইনসুলিন শরীরকে চর্বি জমাতে বাধ্য করে। লিভারে চর্বি জমে NAFLD (Non-alcoholic fatty liver disease) তৈরি হয়।
৪। হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক (Cardiovascular Disease)
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স রক্তনালীর দেয়ালকে শক্ত ও মোটা করে তোলে। ফলে রক্ত চলাচল বাঁধাগ্রস্ত হয়ে উচ্চ রক্তচাপ হয়। এতে করে কোলেস্টেরল ও প্লাক জমে গিয়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
৫। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS)
মেয়েদের হরমোনে ভারসাম্য নষ্ট করে মাসিকের অনিয়ম, বন্ধ্যাত্ব, ব্রণ, অতিরিক্ত লোম গজানো ইত্যাদি তৈরি করে।
৬️। হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ)
ইনসুলিন কিডনিকে বেশি সোডিয়াম জমাতে বাধ্য করে, ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
৭️। আলঝেইমার ও ডিমেনশিয়া
গবেষকরা একে বলেন “টাইপ-৩ ডায়াবেটিস”।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স মস্তিষ্কের কোষে এনার্জি সংকট তৈরি করে, ফলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়।
৮️। ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি
অতিরিক্ত ইনসুলিন একধরনের গ্রোথ-হরমোনের মতো কাজ করে। কোষে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায় যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৯️। গেঁটে বাত ও দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স প্রদাহজনিত কেমিক্যাল নিঃসরণ করে, ফলে জয়েন্ট পেইন, গাউট ও অন্যান্য অটোইমিউন রোগের প্রবণতা বাড়ে।
কেন এত রোগ একসাথে আসে? কারণটা সহজ।
আমাদের শরীর, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, হরমোন, এমনকি মগজ সবকিছুই কোষ দিয়ে গঠিত। যখন ইনসুলিনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন সেই কোষগুলিই এনার্জি পায় না, অকেজো হয়ে পড়ে।
ফলে যেই অঙ্গের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই অঙ্গ গুলিই অকেজো হয়ে পড়ে। আর আমরা বিভিন্ন অঙ্গের এই অকেজো হয়ে পড়াকে বিভিন্ন রোগের নাম দিয়ে অভিহিত করে থাকি এবং সেই সকল রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পেছনে ছুটাছুটি করতে থাকি।
তাই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স আসলে একক কোনো রোগ নয়, বরং একে বলা যায়,“শত রোগের মিছিলের সূচনাবিন্দু।”
ডায়াবেটিস হঠাৎ হয় না। এটি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এক নিঃশব্দ ফাঁদ। ডায়াবেটিস ধরা পড়ার ১০-১২ বছর আগে থেকেই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সে ভুগতে থাকে শরীর।কিন্তু অমরা তা বুঝতে পারি না । যাদের শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স রয়েছে, তারা যেন এক ধীর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।বাইরে থেকে হয়তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে শরীরের প্রতিটি কোষ এক অসহ্য শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
কিন্তু কীভাবে জানবেন আপনি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট কি না?
আপনার ওজন বেশি, পেটের মেদ বেড়েছে, ঘন ঘন ক্ষুধা লাগে, খাওয়ার পর ঘুম পায়, ত্বক কালচে হয়ে যাচ্ছে, ক্লান্তি লেগেই থাকে, মনোযোগ কম- এইসব উপসর্গ থাকলে সতর্ক হোন। কিন্তু নিশ্চিত হতে হলে দরকার সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা—HOMA-IR টেস্ট।
HOMA-IR টেস্ট কী?
HOMA-IR (Homeostatic Model Assessment for Insulin Resistance) টেস্ট মূলত দুটি ডাটা নিয়ে হিসাব করা হয়।
১। ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS)
২। ফাস্টিং ব্লাড ইন্সুলিন (FBI)
Homa IR = (FBS x FBI)/22.5
এই টেস্টের মাধ্যমে বোঝা যায় আপনার শরীর কতটা ইনসুলিন প্রতিরোধ করছে। এই টেস্টটি খুবই কার্যকর, অথচ আমাদের দেশের অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার এটির নামই জানে না। আবার যারা করে, তারা কেবল সূচকটা লিখে দেয়, কিন্তু মূল ফাস্টিং ব্লাড ইনসুলিন ও ফাস্টিং ব্লাড সুগারের মানটা দেয় না, যা থেকে রোগী নিজেই বুঝতে পারতেন আসল অবস্থা।
HOMA-IR এর রেফারেন্স মান ও বিশ্লেষণ:
HOMA-IR রেঞ্জ
১.০ থেকে ১.৯ : স্বাভাবিক, ইনসুলিন সেনসিটিভ
২ থেকে ২.৯ : মাইল্ড ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (সতর্ক হোন)
৩ তেকে ৫ : স্পষ্ট ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (ঝুঁকি বাড়ছে)
৫.১ থেকে ৮ : উচ্চমাত্রার রেজিস্ট্যান্স (চরিত্র বদলাচ্ছে কোষের)
৮.১ থেকে ১২ : কোষে ভারি রেজিস্ট্যান্স, বিপজ্জনক (ফাঁদে ঢুকেছেন)
১২ থেকে বেশি : অত্যন্ত গুরুতর রেজিস্ট্যান্স - ইতিমধ্যে বহু রোগ তৈরি হচ্ছে
উচ্চ মাত্রার ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স মানে, আপনার কোষে সুগার বা ইনসুলিন কোনটাই ঢুকছে না, অথচ অগ্ন্যাশয় ক্রমাগত ইনসুলিন তৈরি করছে। এতে অগ্ন্যাশয়ের উপর চাপ পড়ে, এবং একসময় তা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখনই আসে টাইপ-২ ডায়াবেটিস।
HOMA-IR টেস্ট কোথায় করাবেন?
ভালো যেকোন ল্যাবেই এটা করাতে পারেন। কিন্তু টেস্ট টি যেহেতু তাদের কাছে পরিচিত না, তাই তারা বলে থাকে, এই টেস্ট এখানে হয় না। তাই আপনি Homa IR না বলে, বলবেন,
ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS) ও ফাস্টিং ব্লাড ইন্সুলিন (FBI) টেস্ট করাবো। ৯ থেকে ১২ ঘন্টা না খাওয়া অবস্থায় ব্লাড দিয়ে টেস্ট ২ টি করাবেন।