ঢাকা, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

৭ আশ্বিন ১৪৩২, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী ২০৫০ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানি পাবেনা: গবেষণা

জাকার্তায় ধস নামায় সম্পূর্ণ নতুন রাজধানী নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে

প্রকাশ: ১০:৫৯, ২০ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১১:০৭, ২০ আগস্ট ২০২৫

পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী ২০৫০ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানি পাবেনা: গবেষণা

প্রতীকি ছবি। সংগৃহীত।

 

একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বব্যাপী ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের একটি সুনির্দিষ্ট সর্বোচ্চ সীমা রয়েছে, যা প্রায় ২০৫০ সালের মধ্যে ঘটবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী জল সংকটের ঝুঁকিতে পড়বে।

ক্রমবর্ধমান খরা পরিস্থিতির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির উপর আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে, যা এর নিঃশেষ হয়ে যাওয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে। ভবিষ্যতে এই ভূগর্ভস্থ পানির প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়বে, কারণ খরা আরও তীব্র হচ্ছে, রিপোর্ট করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস (পিবিএস)।

 এই পরিস্থিতি একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে: আমরা কি ভূগর্ভস্থ পানির চূড়ান্ত ব্যবহার বা 'পিক ওয়াটার'-এর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, যেখান থেকে এর সরবরাহ চিরতরে কমতে শুরু করবে?

নতুন গবেষণাটিতে এই বিষয়টি বিশ্বব্যাপী খতিয়ে দেখা হয়েছে। গবেষকদের একটি দল বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সিস্টেম মডেল ব্যবহার করে ৯০০টি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে ছিল বিভিন্ন জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জ্বালানির চাহিদা এবং জল নীতির মতো বিষয়গুলো।

এই ৯০০টি পরিস্থিতির প্রায় সবকটিতেই দেখা গেছে যে বিশ্বব্যাপী ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের একটি নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ সীমা রয়েছে, যা প্রায় ২০৫০ সালের মধ্যে ঘটবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী জল সংকটের ঝুঁকিতে পড়বে।

ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের সর্বোচ্চ সীমা বা 'পিক ওয়াটার' হলো সেই অবস্থা যখন পানি সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায় না, বরং তা এত গভীর এবং ব্যয়বহুল হয়ে যায় যে পাম্প করা লাভজনক থাকে না। এর ফলে: কূপগুলো আরও গভীর করতে হয়। পানি উত্তোলনে খরচ এবং জ্বালানির ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে যায়।

একপর্যায়ে অনেকেই পানি উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। এই পরিস্থিতিকে বিজ্ঞানীরা 'পিক ওয়াটার' বলে উল্লেখ করেছেন। যখন ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অত্যন্ত কঠিন, ব্যয়বহুল বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, তখন এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এটি জীবাশ্ম জ্বালানি বা খনিজ সম্পদের নিঃশেষ হওয়ার মতো একটি প্রক্রিয়া।


ভূগর্ভস্থ জল এবং তেল উভয়ই সীমিত সম্পদ। একবার উত্তোলন করা হলে, এদের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় পুনরায় পূর্ণ হতে কয়েক শত বা হাজার বছর সময় লাগে। এ কারণে ভূগর্ভস্থ পানিকে নবায়নযোগ্য সম্পদ হিসেবে গণ্য করা যায় না, বরং একে একটি সীমিত সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন বৃষ্টিপাত ও খরা আরও চরম ও অনিয়মিত হয়ে উঠছে, তখন ভূগর্ভস্থ পানি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভরসার জায়গা হিসেবে কাজ করছে। নদী শুকিয়ে গেলে বা বৃষ্টিপাত না হলে, ভূগর্ভস্থ পানি স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করে। কারণ এটি সাম্প্রতিক বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল নয়, তাই এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম। তবে, ভূগর্ভস্থ পানি পৃষ্ঠের পানির মতো নবায়নযোগ্য সম্পদ নয়। এর কারণ হলো, ভূ-পৃষ্ঠের পানি (যেমন নদী ও হ্রদ) সহজেই বৃষ্টির মাধ্যমে পুনরায় পূর্ণ হয়। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি সেইভাবে পুনর্ভরণ হয় না। জলাধারের গঠন এবং ভূতাত্ত্বিক অবস্থার উপর নির্ভর করে এর পুনর্ভরণে অনেক সময় লাগে।

এছাড়া, ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলো বিশাল পরিমাণে পানি ধারণ করতে পারে, কিন্তু একবার যখন পানি উত্তোলন করা হয়, তখন মাটির স্তর সংকুচিত হয়ে যায়। এর ফলে জলাধারের ধারণ ক্ষমতা স্থায়ীভাবে কমে যায়, এবং ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাত হলেও আগের মতো পানি জমা হতে পারে না।

এ কারণে, ভূগর্ভস্থ পানিকে একটি অপরিহার্য কিন্তু সীমিত সম্পদ হিসেবে গণ্য করা উচিত, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

খাদ্য উৎপাদন এবং অর্থনীতির উপর প্রভাব

ভূগর্ভস্থ পানি, যা খাদ্য উৎপাদন এবং জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য, তা এমন একটি অপরিবর্তনীয় সংকটের দিকে যাচ্ছে যে বিজ্ঞানীরা এর পরিণতি নিয়ে চিন্তিত হয়েছেন।  প্রাথমিকভাবে এর ফলে খাদ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, যেসব অঞ্চলে 'পিক ওয়াটার' হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তার মধ্যে অনেকগুলোই বিশ্বের প্রধান খাদ্য উৎপাদনকারী অঞ্চল। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে:মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, মেক্সিকো, ভারত, পাকিস্তান, চীন ,মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন দেশ।

এই দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হলে তা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ এবং মূল্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

ক্রমবর্ধমান জল সংকটের কারণে বিশ্বের প্রধান কৃষি অঞ্চলগুলোতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। এর প্রভাব কেবল স্থানীয় খাদ্য সুরক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা বৈশ্বিক বাজারেও ছড়িয়ে পড়বে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে।

ভূগর্ভস্থ পানির সংকট কেবল কৃষির জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এটি পরিবেশের ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল জলাভূমি ও নদীগুলো শুকিয়ে যেতে পারে, যা জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করবে এবং জীবজন্তুর বাসস্থান ধ্বংস করবে। একইসাথে, পানির স্তর নেমে যাওয়ায় আর্সেনিক ও লবণের মতো দূষকগুলো ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা পানির গুণগত মানকে আরও খারাপ করবে।

ভূমির অবনমন (Subsidence): এক নীরব বিপদ

ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের সবচেয়ে গুরুতর পরিণতিগুলোর মধ্যে একটি হলো ভূমির অবনমন । এই নীরব বিপদ এতটাই মারাত্মক যে এরই মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজধানী শহরকে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করতে হয়েছে। এটি পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।

ভূগর্ভস্থ জলস্তর যখন নেমে যায়, তখন মাটির কণাগুলোর মধ্যবর্তী শূন্যস্থান সংকুচিত হতে শুরু করে। ফলে মাটির স্তর ধীরে ধীরে নিচের দিকে বসে যায়। ভূমির অবনমন একটি সুস্পষ্ট লক্ষণ যে একটি অঞ্চল তার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে। এই সংকোচন মাটির জল ধারণ ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে কমিয়ে দেয়। এর ফলে ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়লেও, মাটি আগের মতো পানি ধরে রাখতে পারবে না।

একটি গবেষণায়, গবেষক লিওনার্ড যুক্তরাষ্ট্রের ২৮টি প্রধান শহরের (যেগুলোর জনসংখ্যা ৬ লাখের বেশি) উপর ভূমির অবনমনের প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন।

গবেষণায় তিনি দেখেছেন, প্রতিটি শহরেই পরিমাপযোগ্য ভূমির অবনমন হচ্ছে, যা প্রতি বছর গড়ে এক মিলিমিটার থেকে পাঁচ মিলিমিটারের বেশি।

দ্রুত ডুবে যাওয়া শহর: ২৮টি শহরের মধ্যে হিউস্টন, ডালাস, ফোর্ট ওয়ার্থ, নিউ ইয়র্ক এবং শিকাগো দ্রুততম গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রতিটি শহরেরই এমন কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে ভূমির অবনমনের হার প্রতি বছর পাঁচ মিলিমিটারের বেশি।

লিওনার্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, এই শহরগুলোতে ২৯,০০০টিরও বেশি ভবন উচ্চ থেকে খুব উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। ভূমির এই অসম অবনমনের কারণে রাস্তা, পাইপলাইন, রেলপথ এবং এমনকি ভবনের ভিত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

উপকূলীয় শহরগুলোতে দ্বিগুণ বিপদ

ভূমির অবনমন উপকূলীয় শহরগুলোর জন্য আরও বড় সমস্যা, কারণ এটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে যুক্ত হয়ে বিপদকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে জোয়ারের বন্যা, ঝড় এবং এমনকি শহর সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক শহর এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ হলো ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, নরম মাটি এবং দ্রুত নগরায়নের কারণে শহরটির কিছু অংশ প্রতি বছর ১০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। বর্তমানে, জাকার্তার ৪০%-এরও বেশি অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে চলে গেছে, যা একে বিপজ্জনকভাবে বন্যাপ্রবণ করে তুলেছে। সমস্যা এতটাই গুরুতর যে ইন্দোনেশিয়া সরকার একটি সম্পূর্ণ নতুন রাজধানী শহর নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।

এই তথ্যগুলো থেকে বোঝা যায় যে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার মানবজীবন, অর্থনীতি এবং পরিবেশের জন্য কতটা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন