নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৩০, ২১ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১০:৩২, ২১ অক্টোবর ২০২৫
প্রধান উপদেষ্টা বরাবর ছয়টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের চিঠি। ছবি: বাসস।
মানবাধিকার সুরক্ষা ও সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবধিকার সংস্থা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে এবং বলেছে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে নিরাপত্তা খাত মূলত অসংস্কারকৃত রয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জবাবদিহিতা এবং সংস্কারের প্রচেষ্টায় পুরোপুরি সহযোগিতা করছে না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, যথা, সিভিকাস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, ফর্টিফাই রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট যে ১২ দফা সুপারিশ করেছে, তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এখানে উল্লেখ করা হলো। এই সুপারিশগুলো বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউ.এন. জেনারেল অ্যাসেম্বলি) অধিবেশন চলাকালীন বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আমাদের প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠক করার জন্য আমরা আপনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। জুলাই বিপ্লব এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের অবসানের এক বছরেরও বেশি সময় পরে, অন্তর্বর্তী সরকার মৌলিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার, আইনি সংস্কার শুরু এবং গুম (Enforced Disappearances) ও অন্যান্য নির্যাতনের তদন্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। গত রোববরে হিউম্যান রাইট্স্ ওয়াচ-এর ওয়বসাইটে চিঠিটি দেয়া হয়। (https://www.hrw.org/news/2025/10/19/joint-letter-to-bangladesh-chief-adviser-yunus)
২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে এই সংকীর্ণ সময়ের মধ্যে, “আমরা আপনাকে মানবাধিকার সুরক্ষা আরও প্রসারিত করতে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ও ভবিষ্যতে পশ্চাদপসরণ রোধে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ জানাই। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে নিরাপত্তা খাত মূলত অসংস্কারকৃত রয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জবাবদিহিতা এবং সংস্কারের প্রচেষ্টায় পুরোপুরি সহযোগিতা করছে না।”
পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে গুরুতর নির্যাতনের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে, তবে এটিকে অবিলম্বে চলমান নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক বন্ধ করা উচিত, যার মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন মামলাও রয়েছে যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব বলে মনে হয়।
রোহিঙ্গা বিষয়ক জাতিসংঘ উচ্চ-পর্যায়ের সম্মেলনে আপনি বলেছিলেন যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনই সংকটের একমাত্র সমাধান, এবং "অবিলম্বে পদক্ষেপ" হিসাবে, সদ্য আগত শরণার্থীদের "অবশ্যই প্রত্যাবাসনের অনুমতি দেওয়া উচিত।" রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে মিয়ানমারে বাড়ি ফেরার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু ২০২৩ সালের শেষ থেকে আগত ১৫০,০০০ শরণার্থী সহ সকল রোহিঙ্গার জন্য, বর্তমানে মিয়ানমারের কোনো অংশই স্বেচ্ছামূলক, সম্মানজনক এবং টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য নিরাপদ নয়।
বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি দ্রুত অনুসরণ করার জন্য আমরা আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি:
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা (সিভিকাস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, ফর্টিফাই রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট) যে ১২ দফা সুপারিশ করেছে, তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হচ্ছে:
(এই সুপারিশগুলো বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে)
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ১২ দফা সুপারিশ (সারসংক্ষেপ) - নিরাপত্তা খাত সংস্কার ও জবাবদিহি:
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করুন: জুলাই বিপ্লব এবং বিগত পনেরো বছরে সংঘটিত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন-এর ঘটনায় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনুন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)-এর প্রতি পূর্ণ সহযোগিতা: সামরিক বাহিনীকে আইসিটি-এর বিচার কার্যক্রমে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে এবং বেসামরিক আদালত হিসেবে এর এখতিয়ার মেনে চলতে হবে। এটি যেন আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করুন।
নিরাপত্তা খাত সংস্কার: র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিলুপ্ত করা এবং ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর ক্ষমতা সীমিত করা অপরিহার্য।
র্যাবের দীর্ঘদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস প্রতিষ্ঠানটিকে সংস্কারের বাইরে নিয়ে গেছে।
সামরিক সদস্যদের বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে সরিয়ে নিন।
ডিজিএফআই-এর ক্ষমতা ও ভূমিকা শুধুমাত্র সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রমে সীমিত করতে হবে এবং একটি স্পষ্ট আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে হবে।
রাজনৈতিক অধিকার ও আটক:
নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক বন্ধ: চলমান নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত, বিশেষত আওয়ামী লীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাবযুক্ত মামলাগুলি প্রত্যাহার করা।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল: আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করুন, কারণ এটি বহু-দলীয় গণতন্ত্রের পথকে সংকুচিত করছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও আইনি সংস্কার:
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত: সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা ও আটক বন্ধ করুন এবং তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত করুন।
দমনমূলক আইন বাতিল বা সংশোধন: সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ ২০২৫, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, দণ্ডবিধির মানহানির ধারা এবং সরকারি গোপনীয়তা আইনসহ অন্যান্য দমনমূলক আইন যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলোর বাতিল বা সংশোধন নিশ্চিত করুন।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সুরক্ষা ও প্রত্যাবাসন:
জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন বন্ধ: রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত জোরপূর্বক প্রত্যাবাসনের সব উদ্যোগ বন্ধ করুন।
মানবিক সুবিধা বৃদ্ধি: রোহিঙ্গাদের চলাফেরা, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ আরও বিস্তৃত করার পাশাপাশি তাদের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ কমানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের বিশেষ অনুরোধ, আপনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করুন এবং সাংবাদিকদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক থেকে রক্ষা করুন। সাংবাদিকদের কথিত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে এই সুরক্ষা দিতে হবে, বিশেষ করে যেখানে অভিযোগগুলির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব রয়েছে অথবা যেখানে সেগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা অন্যান্য অধিকারের লঙ্ঘন করে।
আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি, তারা যেন রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় উভয় পক্ষের হয়রানি ও সহিংসতা থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয় এবং যেকোনো আক্রমণের ক্ষেত্রে দ্রুত ও স্বাধীন তদন্ত পরিচালনা করে। একই সাথে, মিডিয়া সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশগুলো, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেগুলো বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সংস্কার: প্যারিস নীতিমালার (Paris Principles) আলোকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সংস্কার ও শক্তিশালী করুন।
আইসিসি'র (ICC) প্রতি পূর্ণ সহযোগিতা: রোহিঙ্গা নিপীড়ন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে চলমান তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করুন এবং আদালতের চাহিদা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হস্তান্তর করুন।