শিরোনাম
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৮:২৬, ১১ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২০:৩৬, ১১ নভেম্বর ২০২৫
পৃথিবীর অর্থনীতি জি৭ থেকে এমার্জিং৭-এ যাচ্ছে। ছবি এঁকেছে জেমিনাই।
ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ইকোলজিক্যাল ইকনমিক্স, ওয়েলবিং ইকনমিক্স এলায়েন্স, দ্য ক্লাব অব রোম ইত্যাদি সংগঠন মনে করে, চীন, ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া এবং তুরস্ক পৃথিবীর অন্যতম ২৫ টি শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হবে ২০৫০ সালের মধ্যে।
উপরোক্ত তিনটি সংগঠন সহ আরও অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, এইসব দেশ উন্নয়নের একটি নতুন মডেল দাঁড় করাচ্ছে যাকে বলা হচ্ছে, 'ওয়ার্ল্ড ইন ২০৫০' মডেল। বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং কতিপয় গোষ্ঠী প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমাজের ভবিষ্যত সম্পর্কিত সাধারণ আলোচনা, এবং নানাবিধ কর্মশালার জন্য ’আমাদের বিশ্ব ২০৫০ সালে’ ("Our world in 2050") এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করে।
এই মডেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ মতামত হলো পৃথিবীর অর্থনীতি জি৭ দেশগুলো থেকে ই৭ (এমার্জিং ৭) এর দিকে যাচ্ছে।
'আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ২০৫০' রিপোর্ট-এর পটভূমি
প্রথম ‘ওয়ার্ল্ড ইন ২০৫০’ (World in 2050) রিপোর্টটি ২০০৬ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই রিপোর্টে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ১৭টি শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতির সম্ভাব্য জিডিপি বৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়। সেই প্রাথমিক মডেলটিতে নিম্নলিখিত দেশগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল: ১০টি বৃহত্তম উন্নত অর্থনীতি: জি-৭ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং জাপান) সেই সাথে অস্ট্রেলিয়া, স্পেন এবং দক্ষিণ কোরিয়া; এবং ছিল সাতটি বৃহত্তম উদীয়মান অর্থনীতি, যাদেরকে আমরা সম্মিলিতভাবে ই৭ হিসেবে উল্লেখ করেছি (চীন, ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া এবং তুরস্ক)।
পরবর্তীকালে গবেষক ও প্রতিষ্ঠানগুলো ২০০৮ সালের মার্চ, ২০১১ সালের জানুয়ারি, ২০১৩ সালের জানুয়ারি এবং ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই প্রক্ষেপণগুলি হালনাগাদ করেন।
পরবর্তীতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নতুন সংস্করণের সাথে, আরও দেশ এই মডেলে যুক্ত করা হয়, যা এখন আরও কিছু দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে, বিশেষত: জি-২০ এর বাকি দেশগুলি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নিম্নোক্ত দেশসময়হের নাম আসে। আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় উন্নত অর্থনীতি হিসেবে নেদারল্যান্ডস, দ্রুত বর্ধনশীল দুটি মাঝারি আকারের দেশ হিসেবে পোল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া এবং পরবর্তী ধাপে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ উদীয়মান বাজার হিসেবে বাংলাদেশ, কলম্বিয়া, মিশর, ইরান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম।
এইভাবে, গবেষকদের 'ওয়ার্ল্ড ইন ২০৫০' মডেলে এখন ৩২টি দেশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে বিশ্বের জিডিপি-র প্রায় ৮৫% প্রতিনিধিত্ব করে।
এক বিশ্লেষন অনুযাযী এই ৩২টি দেশের গ্রুপে ২০৫০ সালে বিশ্বের অন্তত ২৫টি বৃহত্তম অর্থনীতি থাকার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী প্রক্ষেপণের সাথে আসা উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তার কারণে, আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে ২০৫০ সালে এই ৩২টি দেশই বিশ্বের বৃহত্তম ৩২টি অর্থনীতি হবে।
উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে Emerging 7 (E7) হলো সাতটি বৃহত্তম উদীয়মান অর্থনীতির একটি ধারণা, যাদের মধ্যে রয়েছে: ব্রাজিল, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া এবং তুরস্ক। এগুলো মিলিয়ে সাতটি শীর্ষস্থানীয় উন্নত অর্থনীতির একটি অনানুষ্ঠানিক, আন্তঃসরকারি ফোরাম বলা যেতে পারে।
সদস্য দেশ কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একটি "অ-তালিকাভুক্ত সদস্য" (non-enumerated member)।
উদ্দেশ্য: সদস্য দেশগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং জ্বালানি নীতি নিয়ে আলোচনা ও সমন্বয় করে।
২০৫০ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস:
এই পূর্বাভাসগুলি প্রধানত G7 (উন্নত অর্থনীতি) থেকে E7 (উদীয়মান অর্থনীতি)-এর দিকে অর্থনৈতিক ক্ষমতার স্থানান্তরের উপর জোর দেয়।
মূল অনুসন্ধানসমূহ (Key Findings)
১. G7 এর তুলনায় E7 এর দ্রুত প্রবৃদ্ধি: E7 দেশগুলির (ব্রাজিল, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, তুরস্ক) প্রবৃদ্ধি ২০১৬ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বার্ষিক গড়ে প্রায় ৩.৫% থাকবে। একই সময়ে G7 দেশগুলির (কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) প্রবৃদ্ধি বার্ষিক গড়ে প্রায় ১.৬% হবে।
২. ইউরোপ ও আমেরিকার বৈশ্বিক অংশ হ্রাস: এশীয় শক্তিগুলির তুলনায় ইউরোপ ক্রমাগত গুরুত্ব হারাবে। বিশ্ব জিডিপি-তে (পিপিপি-এর ভিত্তিতে) ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ প্রায় ১৫% থেকে কমে ৯% এ নামতে পারে। অন্যদিকে, চীনের অংশ বেড়ে প্রায় ২০% এবং ভারতের অংশ বেড়ে ১৫% হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব জিডিপি-র অংশও কমে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১২% হতে পারে।
৩. শীর্ষ অর্থনীতির পরিবর্তন: ২০৫০ সালের মধ্যে: ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে পিপিপি (PPP) অনুযায়ী বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে পারে আর ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হতে পারে। এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের সাতটি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে ছয়টিই হবে আজকের উদীয়মান বাজার (E7)।
৪. দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ: ভিয়েতনাম, ভারত এবং বাংলাদেশ আগামী ৩৪ বছরে (২০৫০ সাল পর্যন্ত) বার্ষিক গড়ে প্রায় ৫% প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।
E7 এবং G7 অর্থনীতির বৃদ্ধির হার: ২০৫০ সালের প্রক্ষেপণ
E7 অর্থনীতিগুলি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে থাকবে এবং ২০১৬ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বার্ষিক গড়ে প্রায় ৩.৫% শক্তিশালী জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রদর্শন অব্যাহত রাখবে।
গত দশকে আমরা যে ৫% এর বেশি প্রবৃদ্ধির হার দেখেছি, তা ২০২০ সাল পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে উচ্চ হারে চলেছে। এরপর তা ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৩% এ নেমে আসবে। E7 এবং অন্যান্য অর্থনীতির প্রত্যাশিত বৃদ্ধির হার আরও বিস্তারিত দেয়া হলো:
তুলনামূলকভাবে, আমরা G7 অর্থনীতিগুলির ক্ষেত্রে ২০১৬-২০৫০ সময়ের মধ্যে বার্ষিক গড়ে প্রায় ১.৬% বা অনেক ধীর গতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস করছি।
এই হারটি আমাদের ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে দেওয়া পূর্বাভাসের চেয়ে সামান্য কম। এর আংশিক কারণ হলো গত দুই বছরে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রত্যাশা মতো শক্তিশালী হয়নি। তবে, প্রধানত এর কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবণতাগত উৎপাদনশীলতা (trend productivity) বৃদ্ধির একটি সাধারণ পুনর্বিবেচনা। যেহেতু এই মডেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত সীমানা নির্ধারণ করে, তাই এটি অন্যান্য অর্থনীতিতেও ধীর গতির প্রবৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হয়।
চীনের অর্থনৈতিক রূপান্তর কেমন হবে
চীন বর্তমানে একটি রপ্তানি- এবং বিনিয়োগ-নির্ভর অর্থনীতি থেকে ভোগ ও পরিষেবা-ভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ
বিশাল বিনিয়োগ: বর্তমানেও স্থায়ী বিনিয়োগ চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির একটি প্রধান চালিকা শক্তি। সরকারের অবকাঠামো বিনিয়োগে জোরালো উৎসাহের কারণে ২০১৫ সালে স্থায়ী বিনিয়োগ বেড়ে ৩৮ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (USD ৫.৭ ট্রিলিয়ন)-এ পৌঁছেছিল, যা মোট জিডিপি-র প্রায় ৫০%।
চলমান প্রবণতা: নগরায়ণ এবং নতুন সরকারি উদ্যোগ (যেমন: বেল্ট অ্যান্ড রোড, বেইজিং-তিয়ানজিন-হেবেই সিটি ক্লাস্টার, ইয়াংজি রিভার ইকোনমিক বেল্ট এবং আন্তর্জাতিক শিল্প ক্ষমতা সহযোগিতা উদ্যোগ) চালু হওয়ার ফলে এই প্রবণতা আগামী বছরগুলিতেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বৃদ্ধির লক্ষ্য: গড় বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রায় ৬.৫% বজায় রাখার জন্য বিনিয়োগ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা ত্রয়োদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নির্ধারিত (২০১০ সালের তুলনায়) ২০২০ সালের মধ্যে জিডিপি এবং মাথাপিছু জিডিপি দ্বিগুণ করার লক্ষ্য অর্জনে অনেকটা সহায়তা করেছে।
চ্যালেঞ্জ: বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ দুটি: সীমিত প্রান্তিক মুনাফা (diminished marginal returns) এবং বেসরকারি বিনিয়োগের নিম্ন স্তর। মোট বিনিয়োগের ৬০% এরও বেশি হলো বেসরকারি বিনিয়োগ, যা ব্যবসায়ী আস্থার অভাবে ২০১৬ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে মাত্র ২.৫% হারে বেড়েছিল (সরকারি খাতে ২১% এর তুলনায়)। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে ভবিষ্যতে তহবিলগুলো "জোম্বি এন্টারপ্রাইজ"-এর পরিবর্তে উৎপাদনশীল প্রকল্পগুলিতে প্রবাহিত হবে।
বাণিজ্য ও পরিষেবা খাতের গতিশীলতা
রপ্তানি হ্রাস: ২০১৬ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে রপ্তানি ৭.৫% এবং আমদানি ৮.২% সংকুচিত হওয়ায় বাণিজ্যের গতি কমে গেছে। ধীর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দুর্বল চাহিদার কারণে নিকট ভবিষ্যতে মোট আমদানি ও রপ্তানি আরও সংকুচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পরিষেবা ও ভোগের উত্থান: এর বিপরীতে, পরিষেবা খাত তার শক্তিশালী বৃদ্ধির গতি বজায় রেখেছে, যা ২০১৬ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে জিডিপি-র ৫২.৮% এ উন্নীত হয়। ভোগও শক্তিশালী ছিল এবং জিডিপি বৃদ্ধিতে ৭১% অবদান রেখেছিল, যা এক বছর আগের তুলনায় ১৩% বেশি ছিল।
ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস: ২০৩০ সালের মধ্যে পরিষেবা খাত জিডিপি-র প্রায় ৭০% এ উন্নীত হতে পারে এবং চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ভোগ বাজার তৈরি করতে পারে, যা হবে বিশ্বের বৃহত্তম।
দ্বিমুখী বিনিয়োগ প্রবাহ
বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (FDI): চীন এখনও বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য। এই বিনিয়োগ ২০১০ সালের $১১০ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে $১৩৬ বিলিয়ন হয়েছে, যা চীনের আধুনিক শিল্পগুলিকে লালন করার জন্য মূল্যবান প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতা সরবরাহ করছে।
চীনের বহির্গামী বিনিয়োগ: চীন মূল্য শৃঙ্খলে (value chain) উপরে ওঠার সাথে সাথে, আরও বেশি চীনা কোম্পানি সরাসরি বিদেশি ব্র্যান্ড, প্রযুক্তি এবং বাজার নেটওয়ার্ক অধিগ্রহণ করছে। চীনের বহির্গামী বিনিয়োগ ২০১১ সালের ৭৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৫ সালে ১৫০ বিলিয়ন ডলারে এ পৌঁছেছে, যা চীনকে একটি নিট বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী (net global investor) তে পরিণত করেছে।
উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা: এই দ্বিমুখী বিনিয়োগ প্রবাহ চীনের উৎপাদনশীলতা উন্নত করতে সাহায্য করবে, যা বর্তমানে OECD গড় স্তরের প্রায় ২০%। এটি চীনের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও গতি দেবে। (এআই এর তথ্য নেয়া হয়েছে)