প্রকাশ: ০৯:০৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১২:১৩, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত।
এক সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের 'সাদা সোনা' এবং খুলনার প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে পরিচিত চিংড়ি, এখন বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিযোগিতা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভানামি চিংড়ি চাষের প্রসারের কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে।
তবে, বছরের পর বছর স্থবিরতার পর এই খাতটি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তর এই শিল্পের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এর ইতিবাচক ফলও দেখা যাচ্ছে, রিপোর্ট ইউএনবি’র।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (EPB) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে খুলনা থেকে চিংড়ি রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিল ১১,৩০০ কোটি টাকা। কর্তৃপক্ষ এখন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই অঙ্ক দ্বিগুণ করে ২২,৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৫ অর্থবছর পর্যন্ত এই অঞ্চল থেকে ১,৫৩,৩৮৮ মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি হয়েছে, যা থেকে আয় হয়েছে ১৩,৪৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে চিংড়ি ছিল ১,০২,৩৩৯.৬২৯ টন, যা থেকে ১১,৩০১ কোটি টাকা আয় হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে খুলনা একাই ১,২৩,১৫১.১৭ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন করেছে, যার মধ্যে ১৯,৫১২ টন রপ্তানি করে ২,৪৯৯ কোটি টাকা আয় হয়েছে। এই সময়ে এই অঞ্চলের চিংড়ি রপ্তানির হার ছিল ৪২.১৯%।
উৎপাদন বাড়ানোর জন্য, মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা অফিস কয়েকটি কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
১০,৭৫০ জন চাষিকে চিংড়ি চাষে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া।
তাদের মধ্যে ৭,৫০০ জনকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
ঐতিহ্যবাহী চাষিদের উৎপাদন দুই থেকে পাঁচ গুণ বাড়াতে 'ক্লাস্টার-ভিত্তিক চাষাবাদ' উৎসাহিত করা।
এছাড়াও, 'ফিল্ড ডে' কর্মসূচির মাধ্যমে চাষিদের অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে এবং ভালো মানের চিংড়ি নিশ্চিত করতে জৈব-নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা চাষিদের আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দাম পাওয়ার জন্য থার্ড-পার্টি সার্টিফিকেশন নেওয়ার জন্যও উৎসাহিত করছেন।
খুলনার বিভাগীয় মৎস্য পরিদর্শক ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার চিংড়ি শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদী এবং সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
তিনি বলেন, "চিংড়ি চাষের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামো থাকা দরকার। এর মধ্যে চিংড়ি চাষের জন্য অঞ্চলভিত্তিক এলাকা নির্ধারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, রোগমুক্ত পোনার সময়মতো সরবরাহ এবং মানসম্মত খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকা জরুরি।"
তিনি আরও বলেন, পোনা, খাদ্য, ঔষধ এবং রাসায়নিক দ্রব্যের কঠোর পরীক্ষার পাশাপাশি চিংড়ি-সমৃদ্ধ জেলাগুলোতে উৎপাদন এবং মান নিয়ন্ত্রণ তদারকির জন্য একটি পৃথক কর্মী কাঠামো স্থাপন করা গুরুত্বপূর্ণ।
সরদার আরও যোগ করেন, "ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে চিংড়ির রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করা এবং রপ্তানিকারকদের মধ্যে দায়িত্বশীল চর্চা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।"
ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিকুল ইসলাম জহির বলেন, এই অঞ্চলে একসময় ৬৩টি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি ছিল, কিন্তু উৎপাদন হ্রাস এবং বৈশ্বিক বাজারের চাহিদা কমে যাওয়ায় ৩৩টি বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, "ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের বিল বাড়া সত্ত্বেও কিছু কোম্পানি এখনো টিকে আছে। হিমায়িত চিংড়ি খাত এখন পুনরুদ্ধার হওয়া শুরু করেছে।" তিনি বিদ্যুৎ এবং উৎপাদন ব্যয়ের জন্য সরকারের কাছে ভর্তুকি দেওয়ারও অনুরোধ জানান।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, চিংড়ি এখনো দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, ইউরোপে চাহিদা ও দাম কমে যাওয়া এবং বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অনিয়মিত পেমেন্ট আসার কারণে আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব উৎপাদনকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর ওপর কোভিড-১৯ মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
বারবার চালান বাতিল হওয়ায় অনেক রপ্তানিকারক প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তবে সম্প্রতি রপ্তানিতে নতুন করে যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, তা পুরো শিল্পে আশার সঞ্চার করেছে।
খুলনার সংশ্লিষ্ট অংশীদাররা বিশ্বাস করেন যে, যদি ধারাবাহিক নীতি সহায়তা এবং উন্নত উৎপাদন মান বজায় থাকে, তাহলে এই 'সাদা সোনা' তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে এবং বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক খাবারের বাজারে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে।