আল-আমিন শাহরিয়ার, বাসস
প্রকাশ: ১৫:০৭, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৫:২১, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
রুপক ছবি। বাসস।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচাইতে বড় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপন উপলক্ষ্যে উপকূলীয় জেলা ভোলার ইলিশের বাজার মূল্য এখন বেশ চড়া। কারণ, এখানকার নদ-নদীর মিঠা পানির সু-স্বাদু ইলিশ এখন চলে যাচ্ছে ভারতের অন্যতম ব্যাস্ততম নগরী কলকাতার বাজারে, রিপোর্ট বাসসের।
ভারত সরকার সাধারণত সারা বছর বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আমদানি করে না। দুর্গাপূজার সময়ই কেবল বিশেষ অনুমতিতে সীমিত পরিমাণে ইলিশ রপ্তানি করা হয়। এই সীমিত সরবরাহের কারণে স্থানীয় বাজারে এর দাম অনেক বেড়ে যায়।
তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘ মাস পর এখানকার নদী ও সাগরে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ ধরা পড়লেও সেই ইলিশের স্বাদ নিতে পারছেন অনেক জেলাবাসী। এটির কারণ হিসেবে জেলেরা দুষছেন একশ্রেণীর অতি মুনাফালোভী ও আড়ৎদারদের। সরেজমিনে ভোলার বিভিন্ন মাছঘাট ও আড়ৎসমূহে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইলিশ পাচারের আদ্যোপান্ত।
ভোলার নাছির মাঝি ঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী সিহাবউদ্দিন জানান, দুর্গাপূজার মৌসুমের সাথে ভোলা উপকূলে আহরিত ইলিশের একটি যোগসূত্র রয়েছে। তিনি বলেন, পূজার মৌসুমেই ভোলার নদীতে ইলিশের যেন ঝাঁক আসতে শুরু করে। তখন তিনিসহ অন্যান্য মাছ ব্যবসায়ীরা ভারত অর্থাৎ কলকাতার বাজারে এলসি খুলে ইলিশ রপ্তানিতে ব্যতি-ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অধিক লাভের আশায় তারা স্থানীয় বাজারের চাইতে কলকাতার বাজারে ইলিশের অধিক মূল্য গুনতে পারেন বলেই এখানকার হাটবাজারগুলো হয়ে পড়ে প্রায় ইলিশশূন্য।
তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশ হতে ভারতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইলিশ রপ্তানি হতো কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বানিজ্য মন্ত্রণালয় এবার তা সীমিত করেছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরটি এবার ভারতে ১২শ' মে. টন ইলিশ রপ্তানির বাধ্যবাধকতা জুড়ে দিয়েছে। গত বছর দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওইবার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে শেষ পর্যন্ত ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল। এবার এর অর্ধেক ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়া হয়। গত বছর সব মিলিয়ে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়া হয়েছিল ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে।
অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি ইলিশ রপ্তানি না করা, অনুমতি কোনোভাবেই হস্তান্তর না করা এবং অনুমোদিত রপ্তানিকারক ছাড়া ঠিকায় (সাব-কন্ট্রাক্ট) রপ্তানি না করার শর্তও দেয়া হয়েছে সরকারের ওই আদেশে। তাতে বলা হয়েছে, সরকার যেকোনো সময় এ রপ্তানি বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু ভোলা উপকূলের মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন, সরকারের দেয়া নিয়মে নানা কথা থাকলেও অধিকাংশ এলসিকারক এসব নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। তারা বিভিন্ন পন্থা ও কৌশল খুঁজে পূজার মৌসুমে কলকাতার বাজারে ইলিশে সয়লাব করে দিচ্ছেন।
ভোলার সাগর কুলের চরফ্যাশন উপজেলার প্রাচীন মৎস্য কেন্দ্র সামরাজ বন্দরের মাছ রপ্তানিকারক মীজানুর রহমান বলেন, ভোলার ইলিশগুলো প্যাকেটজাত করে আমরা যশোরের বেনাপোল স্টেশন ক্রস করে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনের পাশের মানিকতলা বাজার নিয়ে যাই। ওই বাজারটি ইলিশ মাছ বিক্রির জন্য বিখ্যাত। তিনি জানান, দুর্গাপূজার আগে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও সেখানকার শহরতলির বাজারে ভোলার ইলিশ গেলেই ক্রেতা ও বিক্রেতাদের আনন্দের সীমা থাকে না। অপর মাছ চালানকারী মাইনউদ্দিন মিয়া বলেন, আমরা যে ইলিশগুলো সংগ্রহ করে ভারতে বিক্রি করি তা স্থানীয় বাজারের চাইতে কলকাতায় ভালো দাম পাই। আবার সেই ইলিশ আমাদের চাইতে কলকাতার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয় আরো চড়া মূল্যে। তিনি বলেন, সেখানকার খুচরা বাজারগুলোতে ভোলার মেঘনা ও তেতুলিয়ার প্রতি ৭শ' গ্রাম থেকে ১ কেজি ২শ' গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮শ' থেকে ২ হাজার ৩শ' রুপিতে।
ভোলা সদরের তুলাতুলি মৎস্যঘাটের ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম জানান, পশ্চিমবঙ্গের বাজারে গত বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে ভোলার মিঠা পানির স্বাদের ইলিশ রপ্তাণী শুরু করেছি। তিনি জানান, ভোলার ইলিশ কলকাতার পাতিপুকুর, শিয়ালদহ, বারাসাত ও হাওড়া এলাকার হোলসেল মাছ বাজারে নিলাম হওয়ার পর সেই মাছ খুচরা বিক্রেতাগণ সেখানকার বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যান।
দুর্গাপূজার সময় বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি হয় কলকাতা ও সারা পশ্চিমবঙ্গে, যার মধ্যে ইলিশের নানা পদ বিশেষ স্থান দখল করে। ইলিশ ভাপা, সর্ষে ইলিশ, ইলিশ পাতুরি—এসব পদ ছাড়া অনেক বাঙালির কাছে পূজার আনন্দ অসম্পূর্ণ মনে হয়। এছাড়া, কলকাতার অনেক পরিবারই পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে এসেছেন। তাদের কাছে দুর্গাপূজার সময় পদ্মার ইলিশ খাওয়া পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি কেবল একটি খাবার নয়, বরং এক ধরনের সাংস্কৃতিক এবং আবেগী বন্ধন।
ইলিশ রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজন পুরোনো ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার ইলিশের তুলনায় ভোলার ইলিশের দাম কলকাতার বাজারে খুব চড়া। তাই আমরা দুর্গাপূজার মৌসুমেই কলকাতার বাজারে ভোলার ইলিশ রপ্তানির মাধ্যমে পুরো বছরের মাছ ব্যবসার লোকসান পুষিয়ে লাভের মুখ দেখতে পারি।
ভোলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মেহেদী হাসান ভূঁইয়া বাসস'কে বলেন, এবার ভোলার নদ-নদীতে ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে এখানকার ইলিশ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করলে রাষ্ট্র অধিক লাভবান হতে পারবে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।