ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯:২২, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত।
কফি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে একটি বিশ্বব্যাপী পণ্যে বিকশিত হয়েছে, যা খামার থেকে কাপ পর্যন্ত শ্রম-নিবিড় যাত্রার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করে।
লাখ লাখ মানুষের দিন শুরু হয় এক কাপ কফি দিয়ে। কিন্তু এই পানীয়টি আপনার হাতে পৌঁছানোর আগে বহু মহাদেশ ও প্রজন্ম ধরে এক কঠিন প্রক্রিয়া পেরিয়ে আসে। কফি কেবল একটি কৃষিপণ্য নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক শক্তি যা ঐতিহ্যকে রূপ দেয় এবং সামাজিক জীবনের একটি বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে কাজ করে। এই যাত্রার শুরু হয় চারা রোপণের মাধ্যমে এবং শেষ হয় একটি কাপে এসে। এর মধ্যে রয়েছে ধৈর্য, দক্ষতা এবং নিষ্ঠার এক দীর্ঘ পরিক্রমা, লিখেছে তুরস্কের ডেইলি সাবাহ।
ইন্টারন্যাশনাল কফি অর্গানাইজেশন (আইসিও)-এর যোগাযোগ কর্মকর্তা এস্টেলা ক্যান্ডিডো কোটেস জানান, কফির বৈশ্বিক পণ্যে পরিণত হওয়ার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু ধাপ—চাষ, সংগ্রহ, ভেজা বা শুকনো প্রক্রিয়াজাতকরণ, শুকানো, গুড়ো করা, রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা এবং জাহাজীকরণ। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, অবকাঠামো এবং প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে এই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়।
জমিন থেকে সংগ্রহ পর্যন্ত
কফির যাত্রা শুরু হয় ছায়াঘেরা নার্সারিতে চারা রোপণের মধ্য দিয়ে। নিয়মিত পানি দেওয়া হয় এবং সরাসরি সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করা হয়, সাধারণত বর্ষাকালে এসব চারা জমিতে লাগানো হয়। একটি কফি গাছে ফল আসতে তিন থেকে চার বছর সময় লাগে। ফল পাকার পর তা লাল বা বেগুনি রঙ ধারণ করে, যা সংগ্রহের সংকেত দেয়। বেশিরভাগ দেশে বছরে একবার ফসল সংগ্রহ করা হয়, তবে অনুকূল পরিবেশের কারণে কলম্বিয়ার মতো অঞ্চলে বছরে দুইবার ফসল সংগ্রহ করা সম্ভব।
অধিকাংশ দেশে হাত দিয়ে কফি তোলা হয়, যা খুবই শ্রমসাধ্য কাজ। তবে ব্রাজিলের মতো বিশাল ও সমতল বাগানে যান্ত্রিক হার্ভেস্টার ব্যবহার করা হয়। ফল তোলার দুটি পদ্ধতি আছে: পুরো ডাল থেকে ফল ঝেড়ে ফেলা অথবা শুধুমাত্র পাকা ফল বেছে বেছে সংগ্রহ করা, যা অ্যারাবিকা কফির জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়।
প্রক্রিয়াজাতকরণের পদ্ধতি
ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি কফির স্বাদ এবং সুগন্ধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঐতিহ্য অনুসারে, প্রধানত তিনটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়: শুকনো, ভেজা এবং মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ। শুকনো পদ্ধতিতে পুরো ফল রোদে শুকিয়ে খোসা সরানো হয়, যা কফিতে একটি ফলের স্বাদ যোগ করে। ভেজা পদ্ধতিতে বাইরের স্তর ধুয়ে ফেলা হয়, এতে একটি পরিষ্কার ও ফুলের মতো সুগন্ধ পাওয়া যায়। মধু পদ্ধতিতে ফলের শাঁসের কিছুটা অংশ দানার ওপর রেখে দেওয়া হয়, যা কফিতে একটি ক্যারামেলের মতো মিষ্টি স্বাদ নিয়ে আসে।
স্বাদের জন্য রোস্টিং
রোস্টিং বা ভাজার প্রক্রিয়াটি কফির স্বাদকে সংজ্ঞায়িত করে। এটি মূলত কফিপ্রেমীর পছন্দের উপর নির্ভর করে। সাধারণত হালকা, মাঝারি বা গাঢ় রোস্ট করা হয়। হালকা রোস্ট কফির আসল সুগন্ধ এবং অম্লতা ধরে রাখে। মাঝারি রোস্ট, যা যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়, একটি ভারসাম্যপূর্ণ স্বাদ দেয়। গাঢ় রোস্টে কফি দানাগুলো চকচকে কালো হয় এবং এতে অম্লতা কম কিন্তু স্বাদ শক্তিশালী হয়। রোস্টিং ক্যাফেইনকেও প্রভাবিত করে; হালকা রোস্ট বেশি ক্যাফেইন ধরে রাখে।
সংস্কৃতি ও অর্থনীতি
কোটেস জানান, অ্যারাবিকা এবং রোবাস্টা বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাত। উচ্চ উচ্চতায় উৎপাদিত অ্যারাবিকা বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ৫৭%। অন্যদিকে, রোবাস্টা রোগ প্রতিরোধী এবং এর স্বাদ কটু। লিবারিকা এবং এক্সেলসা বেশিরভাগই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উৎপাদিত হয়।
উৎপাদন ও রপ্তানিতে ব্রাজিল বিশ্বে শীর্ষে, এরপর রয়েছে ভিয়েতনাম, কলম্বিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। আমেরিকা সবচেয়ে বড় ভোক্তা হলেও, মাথাপিছু কফি সেবনে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো শীর্ষে। কোটেস বলেন, “ব্রাজিল একই সঙ্গে একটি প্রধান উৎপাদক ও বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হিসেবে অনন্য।”
তিনি আরও জানান, তুরস্কের জলবায়ু কফি চাষের উপযোগী না হলেও, তুর্কি কফির দীর্ঘ ঐতিহ্য এটিকে কফির জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক স্থান দিয়েছে। তুরস্কে কফি সেবন ২০১৫-২০১৬ সালের প্রায় ১.১১ মিলিয়ন ব্যাগ থেকে ২০২৩-২০২৪ সালে ২.১৬ মিলিয়ন ব্যাগে উন্নীত হয়েছে।
কোটেস জোর দিয়ে বলেন যে কফি কেবল একটি "অর্থনৈতিক পণ্য" নয়, এটি "সমাজ জুড়ে একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি" হিসেবে কাজ করে। এটি বিশ্বব্যাপী ২৫ মিলিয়নেরও বেশি পরিবারের জীবিকা নির্বাহে সাহায্য করে। তিনি সতর্ক করে বলেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন ঐতিহ্যবাহী কফি উৎপাদন অঞ্চলগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মতে, “জলবায়ু-সহনশীল ফসল এবং পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি অত্যাবশ্যক হবে।”