ঢাকা, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

৭ আশ্বিন ১৪৩২, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

চট্টগ্রাম বন্দর ও রেলওয়ে

পণ্য আটকে প্রায়ই লোকসান গোনেন ব্যবসায়ীরা

গড়ে ওঠেনি সহজ পরিবহন ব্যবস্থা

রিপোর্ট বণিক বার্তার

প্রকাশ: ১০:৫৪, ২৪ আগস্ট ২০২৫

পণ্য আটকে প্রায়ই লোকসান গোনেন ব্যবসায়ীরা

ছবি: সংগৃহীত।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথে কনটেইনার পরিবহন কার্যক্রম শুরু হয়েছে প্রায় চার দশক আগে। তবে দীর্ঘ এ সময়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এ সেবায় গড়ে ওঠেনি সহজ পরিবহন ব্যবস্থা। পণ্য আটকে থাকায় প্রায়ই লোকসান গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চাইলেও রেলওয়ে পর্যাপ্ত সুবিধা না দেয়ায় কনটেইনার পরিবহন প্রায় স্থবির হয়ে আছে, রিপোর্ট বাণিক বার্তার সুজিত সাহার (চট্টগ্রাম ব্যুরো)। 

দেশের শিল্প ও আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে বন্দরটি থেকে ঢাকায় কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোয় (আইসিডি) রেলপথে কনটেইনার পরিবহন শুরু হয়। ২০০০-০১ অর্থবছরে উভয়পথে (চট্টগ্রাম বন্দর-ঢাকা কমলাপুর আইসিডি) পর্যন্ত কনটেইনার পরিবহন হয় ৫২ হাজার ৭৩৭টি। কয়েক বছরের মধ্যে রেলপথে কনটেইনারের পরিবহন বেড়ে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে উন্নীত হয় ৮১ হাজার ২৭০টিতে। তবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি বছর পণ্য আমদানি-রফতানি ৮-১০ শতাংশ হারে বাড়লেও সে তুলনায় কমেছে রেলপথে কনটেইনার পরিবহন। ফলে বিকল্প পথে পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে ব্যয় বাড়ছে ব্যবসায়ীদের।

জানতে চাইলে ইস্পাত পণ্য আমদানিকারক ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম সোহান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের আমদানি করা ইস্পাত পণ্যের কনটেইনার প্রায় এক মাস ধরে বন্দরে আটকে রয়েছে। প্রতিটি কনটেইনারের জন্য দিন হিসাবে ২৪ ডলার হারে জরিমানা গুনতে হচ্ছে।’ রেলপথে পণ্য পরিবহন করে কমলাপুর আইসিডিতে নিয়ে যেতে বিড়ম্বনার কারণে আমদানি পণ্যগুলো বিক্রিতে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন এ ব্যবসায়ী।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দর দিয়ে আসা কনটেইনারগুলো রেলপথে পরিবহন হলে খরচ কমে যায়। আবার রেলপথে পণ্য পরিবহন হলে পণ্যের ঝুঁকিও কম থাকে। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে পণ্যের শুল্কায়ন নির্ধারণ করে পণ্য আমদানি করেন। কিন্তু অনেক সময় রেলের ইঞ্জিন স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে সময়মতো পণ্য সরবরাহ নেয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য আটকে থাকে দিনের পর দিন। বন্দরে পণ্য আটকে থাকলেও রেলপথে পরিবহন করতে না পারায় খালাসের চারদিন পর থেকেই জরিমানা গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের। বর্তমানে প্রায় এক মাস ধরে বিপুল পরিমাণ কনটেইনার বন্দরে আটকে থাকায় ব্যবসায়ীরা আমদানি পণ্যে বড় ধরনের লোকসান দিচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রথম কথা হলো রেলের ইঞ্জিন সমস্যার কারণে কিছুদিন পর পর আইসিডিগামী কনটেইনার জট হয়ে যায়। বিশেষ করে ঢাকার দিকের আমদানিকারকরা ১৫-২০ দিনের পণ্যের চালান বুঝে পায় না। ব্যবসায়ীরা এতে আর্থিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আমাদের চাওয়া হলো রেলওয়ের ইঞ্জিন সক্ষমতা কাটিয়ে উঠুক দ্রুত। এটা রেলওয়ের জন্য একটা প্রডাক্টিভ খাত যেখান থেকে রেল প্রচুর রেভিনিউ পায়। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো। যেমন ঢাকার কমলাপুর কনটেইনার ইয়ার্ডের মেইনটেন্যান্স পুরোপুরি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ করার কথা থাকলেও সেটাও তারা করছে না। ফলে সেখানকার ইয়ার্ডের রক্ষণাবেক্ষণও আমাদের অর্থায়নে চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

রেলের পরিসংখ্যান বুক-২০২০-এর তথ্যমতে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রেলপথে ৮১ হাজার ৯৩০ কনটেইনার পরিবহনের ১২ বছর পর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেলপথে কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ৮৭ হাজার ৪৭৯টি। বন্দর দিয়ে প্রতি বছর গড়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও রেলপথে পরিবহন বেড়েছে খুবই কম। গত দেড় দশকে লক্ষাধিক কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি নতুন রেলপথ নির্মাণ, নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু হলেও রেলপথে কনটেইনার ও পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। এতে দেশের প্রধান বন্দরের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।

প্রতি মাসে চট্টগ্রাম ও ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে গড়ে ১৮০টি ট্রেন চলাচলের চাহিদা রয়েছে বন্দরের। অর্থাৎ প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে তিনটি ও ঢাকা থেকে তিনটি কনটেইনার ট্রেন চলাচল করলে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার জট হবে না। এছাড়া প্রতি মাসে সিলেটে ২০-২৫টি, শ্রীমঙ্গলে ১০-১২টি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সাত-আটটি এবং রংপুরে ১০-১২টি জ্বালানিবাহী ওয়াগন ট্রেন চলাচলের চাহিদা রয়েছে। এভাবে প্রতিদিন গড়ে উভয় দিকে ৮-১০টি ট্রেন চলাচলের চাহিদা থাকলেও বর্তমানে ট্রেনের সংখ্যা কমে নেমে এসেছে দুই-তিনটিতে।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, পাথর, বোল্ডার, সার, খাদ্যশস্য পরিবহনে রেলের ওপর সরকারি সংস্থাগুলোর চাহিদা থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন করতে পারছে না রেলওয়ে। আগে নিয়মিত বিরতিতে সারা দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে রেলপথে খাদ্যশস্য, নির্মাণ সামগ্রী ও সার পরিবহন হলেও বর্তমানে সেটি কার্যত শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। সর্বশেষ ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে সান্তাহারে একটি ৩০ ওয়াগনের গমবাহী ট্রেন চালিয়েছে রেলওয়ে। ট্রেনে খাদ্যশস্য পরিবহনে টনে ১৬-১৭ হাজার টাকা খরচ হলেও সড়কপথে খাদ্যশস্য পরিবহন খরচ দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ। কিন্তু রেলের ইঞ্জিনের সরবরাহ না থাকায় রেলওয়ে চাহিদা সত্ত্বেও খাদ্যশস্য পরিবহন করতে পারছে না।

রেলের তথ্যমতে, রেলের পণ্য পরিবহন খাতে প্রতিদিন ২৩টি ইঞ্জিনের চাহিদা রয়েছে। তবে স্বাভাবিক পণ্য পরিবহন স্থিতিশীল রাখতে সর্বনিম্ন ১৩টি ইঞ্জিন দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারে পরিবহন বিভাগ। ২০ আগস্ট পণ্য পরিবহনের জন্য ইঞ্জিন সরবরাহ দেয়া হয়েছে মাত্র দুটি। এছাড়া ১৯ আগস্ট দুটি এবং ১৮ আগস্ট পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলে ইঞ্জিন দেয়া হয়েছে মাত্র তিনটি। দীর্ঘদিন ধরে ইঞ্জিন আমদানি না হওয়া, দীর্ঘদিনের পুরনো ইঞ্জিন বিকল হলেও সময়মতো মেরামত করতে না পারায় তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে রেলওয়েতে। যাত্রীবাহী ট্রেনের চাহিদা মেটাতে পণ্য পরিবহন ট্রেনে ইঞ্জিন সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় দেশের শিল্প ও বাণিজ্যে বড় সংকট দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুবক্তগীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের ইঞ্জিন সংকট দীর্ঘদিনের। দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পরিবহনকে গুরুত্ব দিয়ে পণ্য পরিবহনে পর্যাপ্ত ইঞ্জিন সরবরাহের চেষ্টা থাকে রেলওয়ের। অনেক সময় ইঞ্জিনের সংকট, বিকল হওয়ার ঘটনা বাড়লে পণ্য পরিবহন খাতে ইঞ্জিনের সরবরাহ কমে যায়। বর্তমানে কনটেইনারসহ পণ্য পরিবহন কিছুটা কমে এলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে রেলওয়ে প্রকল্পের অধীনে ইঞ্জিন আমদানি, বেশকিছু পুরনো ইঞ্জিন মেরামতের পরিকল্পনা করছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে পণ্য পরিবহন খাতে রেলের হিস্যা আরো বাড়বে বলে দাবি করেছেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি আধুনিক বন্দরের জন্য রেলপথে পণ্য পরিবহন সেবা গুরুত্বপূর্ণ। রেলওয়ে ও বন্দর দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বন্দর চাইলেও ব্যবসায়ীদের কনটেইনার পরিবহনের সেবা বাড়াতে পারছে না। পণ্য পরিবহনে খরচ অনেক কম হওয়ার পাশাপাশি কমলাপুর আইসিডিতে শুল্কায়ন সুবিধার কারণে রেলপথে পণ্য পরিবহন করতে চায়। কিন্তু প্রতি বছর বিভিন্ন সময় রেলের কারণে কনটেইনার জটে ব্যবসায়ীদের লোকসানের পাশাপাশি বন্দরে কনটেইনার জটে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বিঘ্নিত হচ্ছে। উভয় সংস্থা সমঝোতার মাধ্যমে রেলপথে পণ্য আমদানির সংকটগুলো দূর করলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।

রেলের পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রেলওয়ে চাইলে বন্দরের সঙ্গে আলোচনা কিংবা চুক্তি করে পণ্য পরিবহনে যৌথ বিনিয়োগ করতে পারে। রেলে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও রেলপথে পণ্য পরিবহনে আধুনিক কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বিগত সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া অনেকগুলো নতুন ট্রেনের কারণে পণ্য খাতের ইঞ্জিনগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে যুগোপযোগী করতে রেলপথে পণ্য পরিবহনকে সমান গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করছেন তিনি।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন