ঢাকা, সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

৭ আশ্বিন ১৪৩২, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

এলডিসি থেকে উত্তরণ ইস্যু

ব্যবসায়ী মহলের ছয় বছর সময় চাওয়ার কারণ ও সম্ভাব্য কৌশল

ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১০:৩৮, ২৭ আগস্ট ২০২৫

ব্যবসায়ী মহলের ছয় বছর সময় চাওয়ার কারণ ও সম্ভাব্য কৌশল

প্রতীকি ছবি।

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী স্বল্পন্নোত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হবে। ইতোমধ্যেই ব্যবসায়ী মহল ও বিভিন্ন চেম্বারের পক্ষ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে আরও ৫-৬ বছরের সময় নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে সরকারকে। কারণ এলডিসি সুবিধা হারালে হঠাৎ করে রপ্তানিমুখী অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।

কেন অতিরিক্ত সময় চাইছেন ব্যবসায়ীরা?
প্রথমত, রপ্তানিতে শুল্ক ধাক্কা: যদি বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা না পায় তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের  ’অস্ত্র ছাড়া সবকিছু’ সুবিধা শেষ হয়ে গেলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৯-১২% শুল্ক আরোপ হবে। এটি রপ্তানিতে বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
দ্বিতীয়ত, নীতিগত সুযোগ কমে যাওয়া: এলডিসি হিসেবে যেসব বিশেষ সুবিধা ছিল যেমন- রপ্তানি প্রণোদনা, ওষুধ উৎপাদনে মেধাস্বত্ব (TRIPS) ছাড়, এগুলো ক্রমান্বয়ে উঠে যাবে।
তৃতীয়ত, নতুন বৈশ্বিক নিয়মের চাপ: একইসময়ে ইউরোপে আসছে Corporate Sustainability Due Diligence Directive (CSDDD), Eco-Design Regulation (ESPR) ও Digital Product Passport। ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হচ্ছে Carbon Border Adjustment Mechanism (CBAM)। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও সাপ্লাই চেইনের স্বচ্ছতা নিয়েও বাড়বে কঠোরতা।
চতুর্থত, ব্যবসায়ী নেতাদের প্রকাশ্য দাবি: বাংলাদেশের রপ্তানিকারক ও শিল্পপতিরা ইতোমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে বলছেন, ৫-৬ বছরের অতিরিক্ত সময় না পেলে শিল্পে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
 
জাতিসংঘ থেকে সরাসরি ‘গ্র্যাজুয়েশন ডিফারাল’ সম্ভব কি?
এ সম্ভাবনা খুবই কম। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই একবার কোভিডের কারণে ২০২৪ থেকে ২০২৬ পর্যন্ত সময় পেয়েছে। নতুন করে আরও ছয় বছর সরাসরি পিছিয়ে দেওয়া বাস্তবে প্রায় অসম্ভব, যদি না কোন বড় বৈশ্বিক সংকট দেখা দেয়। তবে বিকল্প উপায় হলো সময়মতো উত্তীর্ণ হওয়া, কিন্তু বাণিজ্যিক সুবিধাগুলো ৫-৬ বছর বাড়ানো।

 কীভাবে এই বাড়তি ছয় বছর পাওয়া সম্ভব?
১. বিদ্যমান ট্রানজিশন পিরিয়ড সর্বোচ্চ ব্যবহার: ইইউতে এলডিসি উত্তরণের পরও তিন বছর (২০২৬-২০২৯) পর্যন্ত বর্তমান শুল্কমুক্ত সুবিধা (EBA) বহাল থাকবে। এছাড়া যুক্তরাজ্যে নতুন Developing Countries Trading Scheme (DCTS) চালু রয়েছে। ফলে এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ দেশগুলোও সুবিধা পেতে পারে। অন্যদিকে, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কাস্টমস ইউনিয়নের কারণে একই ধরনের সুবিধা দেবে। অর্থাৎ, ২০২৯ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বহাল থাকবে।
২. তিন বছরের সুবিধাকে ছয় বছরে রূপান্তর: বাংলাদেশকে এখন থেকেই ২৭টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, যাতে ২০৩০ সালে ইইউ’র GSP+ সুবিধা কার্যকর হয়। যুক্তরাজ্যের DCTS-এর মাধ্যমে অতিরিক্ত নমনীয় নিয়মের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে সুবিধা ধরে রাখতে পারবে। এছড়া কানাডা, জাপান, ভারত, চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতি জোরদার করে তাদের কাছ থেকেও ৩-৬ বছরের ট্রানজিশনাল শুল্ক সুবিধা আদায় করা সম্ভব। এতে ২০২৬ থেকে ২০৩২ পর্যন্ত কার্যত শুল্কমুক্ত সুবিধা ধরে রাখা সম্ভব হবে।
৩. বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পর্যায়ে উদ্যোগ: বাংলাদেশকে অন্যান্য উত্তীর্ণ হতে যাওয়া দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ‘Graduation Package’ দাবি করতে হবে। এর আওতায় থাকতে পারে TRIPS-Gi এর (মেধাস্বত্ব আইন)। যা কিছু বর্ধিত সময় দিতে পারে, বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যালসের জন্য। পাশপাশি কিছু স্পেশাল এন্ড ডিফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট (S&DT) ধাপে ধাপে উঠিয়ে নেওয়া।
৪. টেকসই উৎপাদন প্রস্তুতি: ইউরোপের নতুন আইনগুলো (CSDDD, ESPR, CBAM) মানতে হলে এখন থেকেই কারখানা পর্যায়ে ট্রেসেবিলিটি, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, ডেটা ম্যানেজমেন্ট শুরু করতে হবে।
৫. অভ্যন্তরীণ নীতি সংস্কার: রপ্তানি ভর্তুকি ধীরে ধীরে বন্ধ করা এবং তার পরিবর্তে WTO-সম্মত উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তি সহায়তা চালু করা। Bonded Warehouse ও Duty Drawback ডিজিটালাইজ করে দ্রুততর করা। নতুন অর্থায়ন উৎস বের করা। বিশেষ করে সবুজ প্রকল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের থেকে এই অর্থায়নের সুযোগ বের করা।
 করণীয় সময়সূচি
২০২৫-২০২৬’র মধ্যেই ইইউ ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে GSP+ ও DCTS নিশ্চিত করা; WTO-তে ফার্মা ও অন্যান্য খাতের জন্য বিশেষ ছাড়ের দাবি তোলা; টেকসই উৎপাদন মানদণ্ডে প্রস্তুতি শুরু করা; ইইউর তিন বছরের (২০২৬-২০২৯) বাড়তি সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগানো; কানাডা, জাপান, ভারত, চীনের সঙ্গে ট্রানজিশনাল চুক্তি করা; ২০৩০-২০৩২ সালের জন্য ইইউ GSP+ কার্যকর করা এবং রপ্তানি ভর্তুকির পরিবর্তে নতুন প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা কাঠামো চালু করা।

পরিশেষে, বাংলাদেশের জন্য সরাসরি জাতিসংঘ থেকে উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়া কঠিন। তবে ছয় বছরের বাড়তি সময় পাওয়া সম্ভব, যদি আমরা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, WTO-তে বিশেষ দাবি এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কার একসাথে চালাই। এভাবে ২০২৬ থেকে ২০৩২ পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে এবং এলডিসি থেকে উত্তরণ একটি সুযোগে রূপান্তরিত হবে (লেখক চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার সম্পাদক)।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন