বণিক বার্তার সৌজন্যে
প্রকাশ: ১৩:২৪, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রতীকি ছবি। সংগৃহীত।
দেশের মোট ধানের প্রায় ৫৫ শতাংশ বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয়। তাই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বোরো ধানকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে কী পরিমাণ জমিতে বোরো ধানের চাষ হয় সে তথ্য পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছে। তবে সংস্থাটির প্রকাশ করা এ তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্যাটেলাইট ইমেজ প্রযুক্তির মাধ্যমে হিসাব করা বোরো ধান আবাদের জমির পরিমাণ বিবিএসের হিসাবের চেয়ে ১২ শতাংশ কম। জমির পরিমাণ বেশি দেখানোর ফলে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদনের তথ্যও বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ জার্নাল অব এগ্রিকালচারে ‘এস্টিমেশন অব বোরো রাইস এরিয়া ইন বাংলাদেশ ইউজিং সেন্টিনেল-টু ইমেজারি অ্যান্ড মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমস’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পরিচালক হাসান মো. হামিদুর রহমান ও ইন্টারন্যাশনাল মেইজ অ্যান্ড হুইট ইমপ্রুভমেন্ট সেন্টারের সিএসআরডি প্রজেক্টের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেশন অ্যান্ড পার্টনার লিয়াজোঁ এসজি হোসাইন যৌথভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছেন। এ গবেষণার লক্ষ্য ছিল সেন্টিনেল-টু স্যাটেলাইট (১০ মিটার রেজল্যুশন) ব্যবহার করে বোরো ধানের আবাদি জমির মানচিত্রায়ণ করা, বিভিন্ন মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের কার্যকারিতা তুলনা করা এবং বাংলাদেশের কৃষি পর্যবেক্ষণের জন্য কম খরচে, নির্ভুল ও পুনরাবৃত্তিযোগ্য একটি কাঠামো তৈরি করা।
গবেষণায় গুগল আর্থ থেকে স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সারা দেশ থেকে ৬০৬টি নমুনা (২০৫টি ধানের জমি, ৪০১টি অ-ধানের জমি) সংগ্রহ করা হয়; যেখানে জিপিএস ডাটা, ছবি ও কৃষকের সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। গবেষণায় চারটি পরীক্ষিত অ্যালগরিদম ব্যবহার করে বোরো ধানের জমির পরিমাণ হিসাব করা হয়েছে। এ ফলাফলের সঙ্গে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিবিএসের দেয়া বোরো ধানের জমির পরিসংখ্যান তুলনা করে দেখা হয়েছে। বিবিএসের হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরো ধান আবাদের জমির পরিমাণ ছিল ৪৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬২১ হেক্টর। অন্যদিকে উল্লিখিত গবেষণা প্রতিবেদনে সিএআরটি অ্যালগরিদম অনুসারে বোরো ধানের জমির পরিমাণ ছিল ৪১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭৯ হেক্টর। এক্ষেত্রে বিবিএসের পরিসংখ্যানের সঙ্গে পার্থক্য ১২ শতাংশ। কে-এনএন অ্যালগরিদম অনুসারে বোরো ধানের জমির পরিমাণ ৩৮ লাখ ৪০ হাজার ৫৮৬ হেক্টর। এক্ষেত্রে বিবিএসের সঙ্গে পার্থক্য ২০ শতাংশ। আরএফ অ্যালগরিদমে জমির পরিমাণ ২৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬০৯ হেক্টর। এক্ষেত্রে বিবিএসের পরিসংখ্যানের সঙ্গে পার্থক্য ৩৮ শতাংশ। এসভিএম অ্যালগরিদমে জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ লাখ ২ হাজার ৯৬১ হেক্টরে। এক্ষেত্রে বিবিএসের সঙ্গে জমির পরিমাণে পার্থক্য সবচেয়ে বেশি—৫০ শতাংশ।
সরকারি সংস্থার পরিসংখ্যানের সঙ্গে সবচেয়ে কম পার্থক্য থাকার কারণে সিএআরটি অ্যালগরিদমকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ রেজল্যুশনের স্যাটেলাইট তথ্য ও মেশিন লার্নিংয়ের সমন্বয় বাংলাদেশের মতো খণ্ডিত জমির দেশে ধান আবাদের জমির পরিমাণ নির্ধারণে নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে। এ পদ্ধতি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও প্রয়োগযোগ্য। জলবায়ু, মাটি, কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি তথ্যের সঙ্গে এটিকে সমন্বয় করলে ফলন পূর্বাভাসের নির্ভুলতা আরো বাড়বে।
গবেষণা প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক হাসান মো. হামিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের গবেষণা এর আগে কখনো হয়নি। এখানে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসরে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে গবেষণার ফলাফলকে আরো সমৃদ্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এতদিন আমরা প্রচলিত পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন যদি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আরো সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তাহলে সরকারের উচিত সেদিকে জোর দেয়া। এক্ষেত্রে স্পারসোর মাধ্যমে সরকার এ ধরনের গবেষণাকে আরো জোরদার করার পদক্ষেপ নিতে পারে।’
কৃষি গবেষকরা বলছেন, দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে বাড়ছে না খাদ্যশস্যের উৎপাদন। কৃষিজমি হ্রাস, উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষক আয় করতে না পারাসহ বিভিন্ন প্রভাবক কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে ধানের আবাদ হয়েছিল ১ কোটি ১৭ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টরে। আর সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবাদকৃত জমি ১ কোটি ১৪ লাখ হেক্টরে নেমে আসে। অর্থাৎ সর্বশেষ পাঁচ বছরে আবাদকৃত জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। এভাবে প্রতি বছরই কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। এর বিপরীতে পাঁচ বছরে হেক্টরপ্রতি ফলন বেড়েছে কেবল ৪ শতাংশ। আর চাল উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ বেড়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আবাদি এলাকা অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হয়—এ প্রশ্ন আগেও উঠেছে। এটি আমাদের খাদ্যনিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। কারণ এতে সরকার সঠিক পরিকল্পনা নিতে পারে না। উৎপাদন যখন বাড়িয়ে দেখানো হয়, সরকার তখন চাহিদা অনুযায়ী কতটুকু আছে সেটা বুঝতে পারে না। চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি করা প্রয়োজন কিনা সেই বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায়, হঠাৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। খাদ্যপণ্যের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে তখন আমদানিতে বিলম্ব হয়। এতে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়।’
ধানের জমির পরিমাণ নির্ণয়ে বিবিএসের পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা আছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, ‘তারাও (বিবিএস) স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে। তবে স্যাটেলাইটে সবসময় সঠিক ধানের এলাকা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। কাজেই স্যাটেলাইট ইমেজের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা দরকার। দুটো মিলিয়ে সমন্বয় করে প্রতিবেদন তৈরি করলে তথ্যের গ্যাপ (ব্যবধান) কমে আসবে। আর ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত। দীর্ঘ সময় পর প্রকাশ করলে এটি জনগণের কোনো উপকারে আসে না। কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানালে এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকরা পরিকল্পনা সাজাতে পারেন।’
বিবিএসের পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতা ও যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। খোদ সংস্থাটির নিজস্ব এক জরিপেও এর তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যবহারকারী—এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সঙ্গে যৌথভাবে বিবিএসের একটি জরিপ পরিচালিত হয়। শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এ জরিপে অংশ নেন। ‘ব্যবহারকারী সন্তুষ্টি জরিপ-২০২৪’ শীর্ষক এ জরিপে উঠে আসে মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে ২২ দশমিক ১৬ শতাংশ বিবিএসের কৃষিসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন না।
বিবিএসের প্রাক্কলিত হিসাব অনুসারে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বোরোর মোট জমির পরিমাণ ছিল ৪৮ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। এক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৩২ টন ফলন ধরা হয়েছে। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো জমির পরিমাণ ছিল ৪৮ লাখ ৫২ হাজার ২৯০ হেক্টর এবং ফলনের হার ছিল ৪ দশমিক ২৮ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিবিএসের প্রাক্কলনে হেক্টরপ্রতি বোরোর ফলনের হার ছিল ৪ দশমিক ১৫ টন। আলোচ্য অর্থবছরে বিবিএসের প্রাক্কলনের সঙ্গে গবেষণা প্রতিবেদনে বোরো জমির পরিমাণের পার্থক্য ছিল ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪২ হেক্টর। জমির এ হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরোর ফলন ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭২ টন কম হওয়ার কথা।
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৃষি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকে খুশি করার জন্য কাল্পনিকভাবে কৃষি জমি বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা ছিল। আমি আমার এলাকার কথা বলতে পারি—যেমন আমার ইউনিয়নের স্যাটেলাইট ইমেজের ডাটা আমার কাছে আছে এবং যেটা দেখা যাচ্ছে যে সরকারি তথ্যের সঙ্গে এক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পার্থক্য রয়েছে। বর্তমানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে উচ্চ রেজল্যুশনের ডাটা পাওয়া যায়। এগুলো ব্যবহার করা হলে তথ্যের নির্ভুলতা বাড়ে। আমাদের এমন সিস্টেমে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের বিবিএস এখনো এ ধরনের আধুনিক পদ্ধতিতে যায়নি, যার ফলে জমির পরিমাণ বেশি দেখাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতি বছরই ফলন বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। ধানের মোট উৎপাদনের তথ্য হিসাবে নিলে আমাদের এখন যে জনসংখ্যা আছে সেটি আরো ২৫ শতাংশ বেশি হলেও পর্যাপ্ত থাকার কথা। অথচ বিশ্বে এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম চাল আমদানিকারক হচ্ছে বাংলাদেশ।’
বিবিএসের পরিসংখ্যানের সঙ্গে গবেষণা প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যের পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (সরজমিন উইং) মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানভেদে পদ্ধতিগুলো আলাদা। হিসাবের সময় কেউ একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে, আবার কেউ আরেকটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে। কেউ সরাসরি ফিল্ডে কম যাচ্ছে। আবার স্পারসোর ক্ষেত্রে কিছু প্রাযুক্তিক সীমাবদ্ধতা থাকে। তাদের প্রযুক্তিতে ছোট ক্লাস্টার যেমন—১৫-৩০ মিটার বা দুই-তিন বিঘার ছোট আয়তনের যে জমি আছে সেগুলো উঠে আসে না। ফলে সেটি স্পারসোর হিসাবে আসে না। সেজন্য কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। সব মিলিয়ে এসব সমস্যা সমাধানে সমন্বয়ের কাজ চলছে।’