ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫

২৯ কার্তিক ১৪৩২, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

এলডিসি থেকে দেশের উন্নয়ন

‘উত্তরণ ধরে রাখতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতি সহায়তা দরকার’

২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্যাসের মূল্য ২৮৬% বৃদ্ধি

নিজস্ব প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২২:২৭, ১০ নভেম্বর ২০২৫

‘উত্তরণ ধরে রাখতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতি সহায়তা দরকার’

জাতিসংঘের মিশন ও ইউএন-ওএইচআরএলএলএস-এর সাথে বিজেএমইএ নেতৃবৃন্দের সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: বিজিএমইএ

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের প্রস্তুতির বিষয়ে স্বাধীন মূল্যায়নে ঢাকায় আগত জাতিসংঘের মিশন, ইউএন-ওএইচআরএলএলএস (UN-OHRLLS) এর সঙ্গে পোশাক খাতের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর এক কৌশলগত পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।  

আজ সোমবার এক সভায় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান পোশাক শিল্পের পক্ষ থেকে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উত্তরণ-পরবর্তী ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কার ও সহায়তার ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জ এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য একটি সহযোগিতামূলক নীতির উপর গুরুত্বারোপ করেন।

আলোচনাকালে বিজিএমইএ সভাপতি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরেন যে, এলডিসি উত্তরণের এই সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প একযোগে ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয় এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে। বিশেষত, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল সমযকালে গ্যাসের মূল্য ২৮৬% বৃদ্ধি এবং এপ্রিল ২০২৫-এ ক্যাপটিভ ও শিল্প খাতে যথাক্রমে ৪০% ও ৩৩.৩৩% এর মতো উল্লেখযোগ্য মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আর্থিক চাপ। খেলাপি ঋণ ২৭% এর উপর বৃদ্ধি এবং ব্যাংক সুদের হার ১৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়া বেসরকারি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে, বলছে বিজিএমইএ’র প্রেস রিলিজ।। 

মাহমুদ হাসান খান বলেন, লজিস্টিকস ক্ষেত্রেও রপ্তানিকারকরা তীব্র চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছেন। বন্দর কার্যক্রমে অস্বাভাবিক বিলম্ব ও অদক্ষতা থাকা স্বত্ত্বেও অক্টোবর ২০২৫ এ একধাপে চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল ৪১% বৃদ্ধি এবং সড়কপথে পরিবহণে দীর্ঘ সময় ব্যয় শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অধিকন্তু, ২০২৩ সালে ৫৬% মজুরি বৃদ্ধি, ২০২৪ সালে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট ৫% থেকে বৃদ্ধি করে ৯% করা এবং বিকল্প কোন সহায়তার ব্যবস্থা না রেখেই ৬০% নগদ প্রণোদনা হ্রাস রপ্তানিমুখী এই খাতটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে - শিল্পকে এক অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বিজিএমইএ সভাপতি দেশের অর্থনীতির প্রধান দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করেন, যার মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির মন্থরতা, এখন পর্যন্ত ৮% এর উপরে মুদ্রাস্ফীতি বজায় থাকা, কম কর-জিডিপি অনুপাত (৬.৬%) এবং ২৭.৫ বিলিয়ন ডলারের (BPM6 অনুযায়ী) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

গুলশানস্থ ইউএন হাউজে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের নেতৃত্বে আলোচনায় আরও অংশ নেন বিকেএমইএ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান এবং বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল এন্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিটিএলএমইএ) এর চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) এর পরিচালক হোসেন মেহমুদ, বিজিএমইএ এর পরিচালক ফয়সাল সামাদ, সাবেক পরিচালক শরীফ জহির এবং বিজিএমই এর সাবেক পরিচালক ও স্ট্যান্ডিং কমিটি অন এফটিএ অ্যান্ড পিটিএ এর চেয়ারম্যান লুৎফে এম আইয়ুব। 

এছাড়াও, তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, বৈশ্বিক বানিজ্যে অস্থিরতা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্রেতাদের মধ্যে আদেশ হ্রাসের প্রবণতা এবং সুচারু উত্তরণ কৌশল (STS) এর বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সতর্ক করে দেন যে, শিল্পের স্বল্প বৈচিত্র্যতা এবং কাঁচামালের আমদানিনির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি।

বৈঠকে পোশাক রপ্তানিকারকগন একটি স্থিতিশীল ও সুচারু উত্তরণ নিশ্চিত করতে সরকার এবং উন্নয়ন অংশীদারদের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট স্বল্প ও মধ্য-মেয়াদি অগ্রাধিকারমূলক সুপারিশসমূহ পেশ করেন।

এসবের মধ্যে স্বল্প-মেয়াদে রয়েছে ডব্লিউটিও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিকল্প প্রণোদনা চালু, ব্যাংক সুদের হার হ্রাস, এবং ইডিএফ পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাপ কমানো। একইসাথে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং লজিস্টিকস অদক্ষতা (বন্দর ও শুল্ক) দূর করাও অত্যাবশ্যক। বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত করতে স্বল্প মেয়াদে ইইউ জিএসপি প্লাস অর্জন এবং প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে এফটিএ/ইপিডএ আলোচনা দ্রুত শুরু করা অপরিহার্য।

মধ্য-মেয়াদে সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, খেলাপি ঋণ হ্রাস, দ্রুত গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ, এবং দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পের কাঠামোগত ভিত্তি মজবুতকরণ।

পোশাক ও বস্ত্রখাতের নেতারা শিল্পের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ, ডিকার্বনাইজেশন বিনিয়োগে সহায়তাদান এবং প্রযুক্তি অভিযোজন এবং সার্কুলার ইকোনমি কর্মসূচিতে সহায়তার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

সভায় বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশের সফল উত্তরণের পর সকল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারে কমপক্ষে তিন বছরের একটি মসৃণ ট্রানজিশন পিরিয়ড নিশ্চিত করা অপরিহার্য। একই সাথে, শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখা এবং পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের জন্য স্বল্প সুদের বা মিশ্র অর্থায়ন (ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্স) এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন