শিরোনাম
মনির জামান
প্রকাশ: ১৭:২৮, ৬ নভেম্বর ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত।
গুনী প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক ফকরুল চৌধুরী্র নতুন একটা বই আমার হাতে এলো! সুদৃশ্য একখানা গ্রন্থ। নাম “প্রাচ্যের ছায়াপথ”। প্রকাশক ‘সংবেদ’। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারগর। দাম চারশত টাকা।
বইটিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দীর্ঘ-তীব্র টানাপোড়েন নিয়ে সরস আলোচনা করেছেন ফকরুল চৌধুরী। আলোচনাটা এতো প্রাসঙ্গিক—আমার মনযোগ কেড়ে নেয়। বলতেই হয়—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব কিভাবে চলছে এবং কিভাবে চলা প্রযোজন, এই গ্রন্থের পাঠ আমাকে সেসব বিষয়ে জানা-বোঝার পথ খুলে দিয়েছে।
এই গ্রন্থে ফকরুল চৌধুরী প্রাচ্য সম্পর্কে পাশ্চাত্যের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তৎজাত প্রতিক্রিয়ার বর্ননা দিয়েছেন। শতবর্ষের আলোকে ইউরোপিয় বুদ্ধিজীবীরা প্রাচ্য-জ্ঞানকে সময়ের সাথে বদলে নিয়েছে। জুড়ে দিয়েছে নতুন নতুন দৃষ্টিকোন। ফকরুল এই আলোচনাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে নিয়েছেন—প্রাচ্যবাদ, নয়া প্রাচ্যবাদ এবং উত্তর-প্রাচ্যবাদ।
প্রাচ্য মানে এশিয়া, আফ্রিকা; পাশ্চাত্য হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকা। প্রাচ্যের উপর পাশ্চাত্যের নানা প্রকারের শাষণ-শোষণের দীর্ঘ প্রতিক্রয়ায় সমাজ ও চিন্তা-চেতনায় বিচিত্র পরিবর্তন এসেছে। আমরা নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে ক্রমশ পাশ্চাত্যের অনুকারক হয়ে উঠি। জীবনযাপন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় হয়ে উঠি ইউরোপের অনুকারি। এতে করে রাজতন্ত্র-পরবর্তী প্রাচ্যে গজিয়ে ওঠে নব্য দালাল শ্রেনী; যারা নিজস্ব সংস্কতি ও অর্থনীতিকে বিসর্জন দিয়ে গোষ্ঠীসহ উপনিবেশের দালাল হয়ে ওঠে।
আফ্রিকায় যখন ইউরোপিওরা আসে তখন তাদের হাতে ছিলো বাইবেল; আর স্থানীয়রা ছিল ভূমির মালিক। এখন আফ্রিকানদার সবাই নিজ ধর্ম হারিয়ে হয়ে উঠেছে খৃষ্টান; আর জমির মালিক হয়ে গেছে ইউরোপিয়ানরা!
এই আশ্চর্য পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে ফকরুল এর পূর্বাপর আলোচনা করেছেন এই গ্রন্থে! তিনি দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের পর এশিয়া-আফ্রিকার বহু দেশ থেকে প্রত্যক্ষ উপনিবেশ উঠে যায় বটে; শুরু হয় নয়া-উপনিবেশিক কর্মকান্ড। তার একটি, ডিভাইড এন্ড রুল! স্বাধীনতার নামে জাতিরাষ্ট্রগুলোকে ভেঙ্গে দিয়ে গঠন করা হয় সীমানাভিত্তিক নতুন রাষ্ট্রকাঠামো।
প্রাচ্যবাদ একটা বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকান্ড, যেখানে প্রাচ্যকে “অপর” হিসাবে তুলে ধরা হয়। পাশ্চাত্য ভালো; তাদের জ্ঞান, দীক্ষা, সংস্কৃতি উন্নত; পক্ষান্তরে প্রাচ্য খারাপ—পশ্চাৎপদ , জ্ঞান, বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া এবং বর্বর! এই ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে বই-পত্র, জ্ঞানের বিকাশ—যা পুরোটাই ভ্রান্ত, দমনের নামান্তর! ফকরুল শুরু করেছেন, প্রাচ্যবাদের ইতিহাস দিয়ে; যাতে উপনিবেশিক যুগের বাস্তবতা থেকে বর্তমান পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে।
প্রাচ্যবাদের প্রধান উপস্থাপক এডয়ার্ড সাঈদের বিখ্যাত “ অরিয়ান্টালিজম” বইয়ের উপর বিশদ আলোচনা করেছেন ফকরুল, যা প্রাচ্যজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের উপনিবেশিক ধারণাগুলোকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেয়।
তুলে ধরেছেন, পুর্ব-পশ্চিমের সাহিত্য-শিল্পকলায় প্রাচ্যচিন্তার উপস্থিতি নিয়ে। দেখিয়েছেন, পাশ্চাত্য-জ্ঞানধারা কিভাবে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও উচ্চমানের সাংস্কৃতিকে দমন করে তাদের চিন্তা-চেতনার দ্বারা কয়েক শতাব্দী ধরে আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে!
পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীরা বলে, তোমরা মাটিতে বসে হাত দিয়ে ভাত খাও! আর আমরা টেবিল-চেয়ারে বসে কাঁটা চামচ দিয়ে খাই; তোমরা পশ্চাদপদ, আমরা উন্নত। এভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রাচ্যকে হেয়ো করে নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়ে আমাদের কৃষ্টিকে ভুলিয়ে দেয়।
ফকরুল চৌধুরী এইসব বাস্তবতা এতো সুন্দর করে আমাদের জন্য তুলে ধরেছেন, আমরা লহমায় নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে ভাবপ্রবন হয়ে উঠতে পারি। শেকড়ের সন্ধানে উদ্ভূদ্ব হতে প্রেরণা জোগায়।
আত্মানুসন্ধানের এই প্রবনতার নাম উত্তরপ্রাচ্যবাদ। উপনিবেশোত্তর তত্ত্ব ও বাস্তবতা আমাদেরকে নিজেদের দিকে তাকাতে শেখায়।
ফকরুলের লেখা “প্রাচ্যের ছায়াপথ” ধরে হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারি—‘পরের শিক্ষা, পরের ধন/ নহে বিদ্যা, নহে ধন/ হলে প্রয়োজন!
আমার এবং অন্যের—এই যে বাস্তবতা স্বাধীন বাংলায় খুব ভালোকরে বুঝে নিতে হবে। নিজের যাকিছু গৌণ, তাকে মূখ্য করে তুলতে হবে।
অভিনন্দন ফকরুল চৌধুরী, এমন জরুরী একখানা গ্রন্থ আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।