নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬:২৮, ১২ আগস্ট ২০২৫
ছবি প্রতীকি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) অনুমান অনুযায়ী, ২০২৫ সালে প্রায় ২৬.২ কোটি, বা প্রতি চারজনের মধ্যে একজন - ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী কোন কর্মে নিযুক্ত নয়। তারা পড়াশোনা করছে না বা কোনো প্রশিক্ষণেও নেই। অন্য কথায়, তারা হলো Not in Employment, Education or Training বা NEET-এর অন্তর্ভূক্ত। আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন, এতে কী আসে যায়? এর কারণ হলো, জাতিসংঘ ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ৮.৬-এর অংশ হিসেবে NEET-এর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর লক্ষ্য গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিকভাবে তরুণদের কর্মজীবনে সফলভাবে অন্তর্ভুক্তির অগ্রগতি পরিমাপের জন্য NEET-এর হারকে এখন একটি মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই মাপকাঠি অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অগ্রগতি বেশ সামান্য। ILO-এর সর্বশেষ ‘Global Employment Trends for Youth, 2024’ সংস্করণ অনুসারে, ১১০টি দেশ - যেখানে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি তরুণ বাস করে, সেসব দেশ SDG লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশের তুলনায়, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে কোভিড-১৯ মহামারীর পরের বছরগুলোতে NEET-এর হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশে NEET তরুণ তরুণীর সংখ্যা কত?
২০২৩-২০২৪ সালের তথ্যানুসারে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)-এর অনুমান অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ২৭-৩০% তরুণ-তরুণী (১৫-২৪ বছর বয়সী) Not in Employment, Education, or Training ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত রযেছেন।
বিশেষত, তরুণীদের মধ্যে NEET-এর হার অনেক বেশি, যা ৪০%-এরও বেশি। অন্যদিকে, তরুণদের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ১০-১৫%।
সামাজিক রীতিনীতি, বাল্যবিবাহ এবং পারিবারিক দায়িত্ব এই বিশাল পার্থক্যের প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে চাকরি এবং শিক্ষার সুযোগ সীমিত হওয়ায় NEET-এর হার শহরাঞ্চলের তুলনায় কিছুটা বেশি।
অনেক বাংলাদেশি NEET তরুণ-তরুণী নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসে এবং তাদের আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব রয়েছে।
এদেশের মোট তরুণ জনসংখ্যা (১৫-২৪ বছর): প্রায় ৪ কোটি (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘের অনুমান অনুযায়ী)। আর এখানে NEET-এর হার: ২৭-৩০% (আইএলও ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী)
আনুমানিক NEET তরুণ-তরুণীর সংখ্যা: এক কোটি থেকে এক কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে নারী NEET প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ (সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধাগুলোর কারণে এই সংখ্যা বেশি) আর পুরুষ NEET ৩০ থেকে ৪০ লাখ বলে হিসেব করা হয়েছে।
NEET-এর হার তরুণ শ্রমবাজারের অবস্থার একটি নিখুঁত সূচক না হলেও (একটি একক সূচক দিয়ে এটি পরিমাপ করা অসম্ভব), এটি সম্ভবত পূর্বে ব্যবহৃত যুব বেকারত্বের হারের চেয়ে বেশি উপযুক্ত পরিমাপক।
NEET-এর হার গ্রামীণ অঞ্চলে শহুরে অঞ্চলের চেয়ে বেশি থাকে, কিন্তু যুব বেকারত্বের হার এমন হয় না।
শিক্ষাগত যোগ্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে NEET-এর হার কমে আসে, কিন্তু যুব বেকারত্বের হারের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না।
NEET-এর হার তরুণ পুরুষদের তুলনায় তরুণীদের মধ্যে (প্রায়শই অনেক) বেশি থাকে, কিন্তু যুব বেকারত্বের ক্ষেত্রে এমন পার্থক্য দেখা যায় না।
সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো NEET-এর সাথে দুর্বলতার সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যান সংশোধনের ফলে, এখন কোনো ব্যক্তিকে কর্মে নিযুক্ত হিসেবে গণ্য করার জন্য তাকে অবশ্যই মজুরি প্রদান করতে হবে। এর অর্থ হলো, যারা অবৈতনিক কাজে, যেমন জীবনধারণের জন্য কৃষিকাজে নিযুক্ত, তাদের কর্মে নিযুক্ত হিসেবে ধরা হয় না এবং ফলস্বরূপ, যদি তারা পড়াশোনা না করে থাকে, তবে তাদের NEET হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
বাংলাদেশে কিভাবে NEET সমস্যা দূর করা যায়?
বাংলাদেশে NEET (Not in Employment, Education, or Training) সংকট মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি খাত এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে অবশ্যই শিক্ষা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দিয়ে একটি বহুমুখী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হতে পারে:
শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি
ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা: ঝরে পড়া তরুণদের জন্য 'দ্বিতীয় সুযোগ' তৈরি করে এমন শিক্ষামূলক কর্মসূচি (যেমন, ব্র্যাকের কিশোর-কিশোরীদের জন্য 'ELA স্কুল') শক্তিশালী করা।
বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ: Technical and Vocational Education & Training বা TVET এবং Skills for Employment Investment Program, SEIP-এর মতো কর্মসূচিগুলোর ব্যাপক প্রসার ঘটানো।
ডিজিটাল ও STEM শিক্ষা: কোডিং বুট ক্যাম্প, যেমন, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের প্রশিক্ষণ এবং আইটি ফ্রিল্যান্সিং কোর্সের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া।
যুবকদের কর্মসংস্থান ও নীট (NEET) জনগোষ্ঠীর জন্য সমাধাকল্পে পাবলিক-প্রাইভেট চাকরি প্রবল্প নিতে হবে।
কর্মসংস্থান ব্যাংকের ঋণ সম্প্রসারণ করে যুব উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান বাড়াতে হবে।
ব্যক্তি খাতে ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানবিশ নীতি (National Apprenticeship Policy) বাস্তবায়নের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুবকদের প্রশিক্ষণ ও চাকরির সুযোগ দিতে বাধ্য করা।
গার্মেন্টস ও শিল্পখাতে নারীদের সংযুক্ত করা: "বেটার ওয়ার্ক বাংলাদেশ"-এর মতো প্রকল্পের মাধ্যমে নীট যুবকদের, বিশেষত মেয়েদের, কারখানায় চাকরির সাথে যুক্ত করা যেতে পারে।
এদিকে, নারী ও গ্রামীণ যুবকদের জন্য সহায়তার জন্য নমনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, যেমন,
অনলাইন কোর্স (মুক্তপাঠ) নেয়া যেতে পারে। বাড়ির কাজের মধ্যে থাকা নারীদের জন্য ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে।
মাইক্রোফাইন্যান্স ও স্ব-কর্মসংস্থান: ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো এনজিওগুলোর স্বনির্ভরতা প্রকল্প সম্প্রসারণ করতে হবে।
লিঙ্গ সমতার প্রচারণা: ইউএন উইমেন ও সরকারের উদ্যোগে সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করতে হবে।
কৃষি ও গ্রিন চাকুরিতে মনোযোগ দিতে হবে। নীট জনসংখ্যাকে কৃষি-প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, বা জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি পদ্ধতি শেখানো যেতে পারে।
নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে চাকরি: সোলার প্যানেল ইনস্টলেশনের মতো টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে (আইডিসিওল-এর প্রকল্পের মাধ্যমে)। এই খাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশে। সেই সাথে এসব ক্ষেত্রে নেয়া বিভিন্ন দেশের সফল মডেল অনুসরণ করতে হবে।
সরকার ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর করণীয়:
বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাড়ানো (গ্রামীণ এলাকায়)।
প্রাইভেট সেক্টরের সাথে অংশীদারিত্ব (ইন্টার্নশিপ, চাকরি)।
লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতি (চাইল্ডকেয়ার সহায়তা, নমনীয় কাজের সময়)।
ডিজিটাল জব প্ল্যাটফর্ম (ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট কাজের সুযোগ)।
এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করলে ২০২৫-২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নীট যুবকের সংখ্যা কমানো সম্ভব।