মোঃ নাঈম হোসেন তালুকদার
প্রকাশ: ১৬:২৩, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৬:২৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবি: মোঃ নাঈম হোসেন তালুকদার
প্রযুক্তির এই যুগে এক অপরিহার্য পেশা মোবাইল ফোন ও অন্যান্য গ্যাজেট মেরামত করা। মোবাইল ফোন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয় এটি আমাদের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। পড়াশোনা থেকে শুরু করে কর্মস্থলের কাজ, কেনাকাটা, বিনোদন সহ প্রায় সকল কাজেই মোবাইল ফোনের কমবেশি ব্যবহার রয়েছে। আর তাই যখন কোন কারণে আমাদের শখের বা প্রয়োজনীয় মোবাইলটি নষ্ট হয়ে যায, তখন একমাত্র মোবাইল টেকনিশিয়ানই আমাদের একমাত্র ভরসা। এই পেশাটি বাইরে থেকে দেখে সহজ মনে হলেও এর ভেতরের গল্পটা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মোহাম্মদ রায়হান উদ্দিন বয়স ২৬ বছর, গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। এখন থাকেন মিরপুর ১ এর শাহ আলী থানার পাশের রাস্তার একটি বাসায়। মোবাইল সারানোর একটি দোকান দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের তৃতীয় তলায়। দোকানের নাম হামিম ব্রাদার্স।
তাঁর জীবনে একটি করুণ টার্ণিং-পয়েন্ট গল্প আছে। তিনি ২০১৬ সালে ইটালিতে যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে আবেদন করেন। কিন্তু অনেক সময় লাগবে সেই আবেদন নিষ্পন্ন হতে, তাও তাঁর যাবার কোন গ্যারান্টি নেই। পরে তাঁর গ্রামের কিছু যুবক দালালের মাধ্যমে লিবিয়া বা ইটালি যাবে এমন খবরে তিনি তাঁদের সাথে যুক্ত হন । কিন্তু রায়হান উদ্দিনের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, দালাল তাঁদের সবার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। সালটা ২০১৭… তখন রায়হান উদ্দিন কি থেকে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। গ্রামে তাঁর ভাইযের একটি মোবাইল সেট বিক্রির ও ফোন সেট সারানোর দোকান ছিল। পরে রায়হান তাঁর ভাইয়ের কাছে প্রাথমিকভাবে দুই বছর হাতে-কলমে মোবাইল সেট কি করে ঠিক করতে হয়, সে বিষয়ে ট্রেনিং নেন। পরে কিছুটা কাজ শিখে তিনি শরীয়তপুরে সরকারিভাবে মোবাইল মেরামতের কোর্সে ভর্তি হন। সেখানে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর,২০২২ সালে গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন ভাল রোজগারের আশায়। পরে একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে যোগদান করে তাঁর কাজের দক্ষতা ঝালাই করে নেন। তাঁর কাজের মান দেখে মালিক তাঁকে তাঁর নিজের ব্যবসার অংশীদার করে নেয়ার প্রস্তাব দেন। আয়ের ৩০ ভাগ নিবেন রায়হান আর মালিক নিবেন ৭০ ভাগ। সবকিছু চলছিল ভালই। কিন্তু ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে তার দোকানের মালিক দেশের বাহিরে চলে যাবার সময় কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। পরে রায়হান দোকানটি নিজেই চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। এই দোকানের পজেশন নিতে তাঁর গ্রামের একটি জমি বিক্রি করতে হয়েছিল।
কি কারনে মোবাইল ফোন নষ্ট হয়, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন সাধারণত নতুন ফোন নষ্ট হয় না, যদি হাত থেকে পড়ে না যায় বা পানিতে যদি পড়ে না যায়। পুরাতন ফোন নষ্ট হবার সম্ভবনা থাকে বেশি। চার্জার, ডিসপ্লে সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। কখনও মাদারবোর্ড কাজ করেনা, আবার কখনও মাদারবোর্ডে আইসি অকেজো হয়ে যায়। ডিসপ্লে ভেঙ্গে যাওংয়া আরেক সমস্যা। এছাড়াও সফটওয়্যার জনিত সমস্যা তৈরি হতে পারে।
রাযহান তাঁর খদ্দেরকে মিথ্যা বলেন না বলে দাবি করেন। কেবল যেই অংশ নষ্ট হয়েছে, সেটিই ঠিক করার কথা বলেন তিনি।
”আমি এই ধরনের (চিটিং) কাজ করি না,ফোনের যা নষ্ট হয়েছে তাই ভোক্তাকে প্র্যাকটিক্যালী দেখিয়ে দেই। আবার, এদিকে একটি নতুন যন্ত্র বের হয়েছে যা মোবাইলের কি নষ্ট হয়েছে তা নির্ণয় করতে পারে। তিনি এখন ঐ যন্ত্রটি কেনার কথা ভাবছেন।
তিনি আরো বললেন, মোবাইল ফোন সার্ভিস নিয়ে সাধারণত পুরাতন খদ্দেরই আসেন বেশি, কেননা তারা তাদের এই শখের বা প্রয়োজনীয় ফোনটি সবার হাতে দিতে ভরসা পান না । তাই তাঁর কাছে অধিকাংশ পুরাতন খদ্দের বেশি আসেন।
মোবাইল ফোন মেরামত করার কাজ একাধারে সূক্ষ্ম ও চ্যালেঞ্জিং। স্মার্টফোনের ভিতরে জটিল সার্কিট, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টস ও সফটওয়্যার সংক্রান্ত নানা সমস্যা সমাধান করতে একজন টেকনিশিয়ানকে প্রতিনিয়ত নিজের দক্ষতা বাড়াতে হয়। কারণ প্রযুক্তির প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে এবং নতুন নতুন মডেলের ফোন বাজারে আসছে । একজন টেকনিশিয়ানকে হার্ডওয়ার এবং সফটওয়্যার উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষ হতে হয় শুধুমাত্র যান্ত্রিক সমস্যা নাই অনেক সময় ডাটা পুনরুদ্ধার বা বিভিন্ন এপ্লাই সংক্রান্ত কাজ করতে হয়।
এই কাজ করার জন্য তাকে অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি কিনতে হয় যার মধ্যে রয়েছে ডিসপ্লে চেঞ্জ করার মেশিন, হট গান পাওয়ার সাপ্লাই, শর্ট ফিল্ম ও বেসিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।
মোবাইল ফোন সার্ভিসিং এর পাশে পাশে তিনি মোবাইলের অ্যাক্সেসরিজ জিনিস ডিসপ্লে মোবাইলের ব্যাক কভার, চার্জার ইত্যাদি বিক্রি করে থাকেন। এই আইটেমগুলো তিনি পাইকারী দোকানীরা তাঁকে দিয়ে যায়। এছাড়া, তিনি মোতালেব প্লাজা থেকে এই পণ্যগুলো পাইকারি মূল্যে এনে থাকেন।
তিনি আরো বলছিলেন তাঁর কাজে সহযোগিতা করার জন্য তাঁর খালাতো ভাইকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন। তার সকল ধরনের খরচ তিনি বহন করেন। মোবাইল টেকনিশিয়ানের কাজ এক নীরব যোদ্ধার মত। তাঁদের পেশা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করেছে… তাই তাদেরকে আমরা সম্মান জানাই।